শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী

খুচরা ও পাইকারি ব্যবসার মাধ্যমে মূল্যসংযোজন বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৫২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ফলে এ খাতে নারীদের অবদান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ হিসাবে নিলেও তাদের মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার মূল্যসংযোজন হচ্ছে। এর মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বিতা যেমন বাড়ছে তেমনি নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়ে যাচ্ছে। বিবিএসের তথ্যমতে, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে ২৬ লাখ ৫০ হাজার ১২৩টি প্রতিষ্ঠানে ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ৯০০ জন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টিতে নিয়োজিত ছিলেন ১ কোটি ৪১ লাখ ৪ হাজার ৭৫৩ জন।
ম নন্দিনী ডেস্ক
  ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে নারী পরিবার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে চলেছে। নারী অবগুণ্ঠন পরে এখন আর ঘরের কোণে বসে থাকা জীবন নয়। সমান তালে তারা জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বত্র কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি এক নবজাগরণের সূচনা করেছে। দেশের প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অবদান অপরিহার্য। বর্তমানে নারীরা ডাক্তার, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসন, সমাজসেবী, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব ক্ষেত্রেই

প্রতিভার পরিচয় দিচ্ছে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় নারী : বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে পালস্না দিয়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে অন্যতম প্রভাবক খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা। এ খাতের বার্ষিক মূল্যসংযোজন ৩ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেড় দশক আগেও পুরুষেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এ ব্যবসায়। নারীদের অংশগ্রহণ ছিল দেড় শতাংশেরও নিচে। তবে এ পরিসংখ্যান পাল্টেছে। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় এখন নারীদের অংশগ্রহণ ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এক দশকের ব্যবধানে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

জিডিপির হিসাবের ক্ষেত্রে ২১টি প্রধান খাতকে বিবেচনা করা হয়। এসব খাতের মধ্যে অন্যতম পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাবাণিজ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) 'হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০' শীর্ষক জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপের সাময়িক প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান ছিল ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি। এসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষ উদ্যোক্তা ছিলেন ১ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন। আর নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৯। তবে পুরুষের তুলনায় এখনো কম হলেও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা এক দশকে ১২৬ শতাংশ বেড়েছে।

ই-কমার্সভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের বর্তমান সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়ে উইয়ের সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা সম্প্রতি বলেছেন, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, সুযোগ-সুবিধা ও পরিবারের প্রয়োজনেই প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই উদ্যোক্তা হচ্ছেন নারী। তবে কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতি নারীদের জন্য নতুনভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। তবে ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য নারীরা বেশ প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছেন। প্রথমত, ডেলিভারি সিস্টেম ও পরিবহণ সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে নারীদের। গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে এ দুটি ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে নারীদের আরো বেশি উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ইন্টারনেট সুবিধা আরো সাশ্রয়ী ও ভোক্তাবান্ধব করা প্রয়োজন।

তথ্যমতে, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসার মাধ্যমে মূল্যসংযোজন বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৫২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ফলে এ খাতে নারীদের অবদান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ হিসাবে নিলেও তাদের মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার মূল্যসংযোজন হচ্ছে। এর মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বিতা যেমন বাড়ছে তেমনি নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়ে যাচ্ছে।

বিবিএসের তথ্যমতে, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে ২৬ লাখ ৫০ হাজার ১২৩টি প্রতিষ্ঠানে ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ৯০০ জন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টিতে নিয়োজিত ছিলেন ১ কোটি ৪১ লাখ ৪ হাজার ৭৫৩ জন। নারী উদ্যোক্তাদের মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে কৃষি ও মৎস্য খাত ছাড়াও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন, ফ্যাশন ও সৌন্দর্য পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায় বেশি আগ্রহ রয়েছে। পাশাপাশি গার্মেন্ট ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পার্লার, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি, ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য ও হ্যান্ডিক্র্যাফটস খাতে নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে।

পোশাক শিল্পে নারী : ঘর-সংসার ও সন্তানের লালন-পালন ছাড়াও স্বল্প শিক্ষিত নারীরা আজ ঘরে বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রম দিচ্ছে। বর্তমানে গার্মেন্ট ও বিভিন্ন ফেক্টরিতে, রাস্তা তৈরির কাজে নারী শ্রমিকের সংখ্যাও কম নয়। পোশাক খাতে এখন মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে নারী ২৪ লাখ ৯৮ হাজার আর পুরুষ ১৭ লাখ ২২ হাজার। ৫ বছর আগে পোশাক খাতে মোট ৪০ লাখ ১ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯১ হাজার। আর পুরুষ ছিলেন ১৪ লাখ ১০ হাজার। প্রতিনিয়ত নারীরা বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। তবে তারা কম বেশি নিজ নিজ পেশায় উপেক্ষিত। দেশের গার্মেন্ট শিল্পে প্রচুর নারী কাজ করছে। কিশোরী থেকে ত্রিশোর্ধ পর্যন্ত নারীদের এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে সবার চাকরির স্থায়িত্ব বা বেতনের নিশ্চয়তা নেই। মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে চাকরি থাকবে কি থাকবে না। গার্মেন্ট মালিকরা বলে থাকেন, নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে মনোযোগী এবং কাজও ভালো করেন। পারিশ্রামিকও কম দিয়ে কাজ করানো যায়। তাই সব দিক থেকে নারী শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো সুবিধাজনক। আর এজন্যই গার্মেন্ট শিল্পে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য।

গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করতে হলে বেশি শিক্ষার প্রয়োজন হয় না। অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত নারীরা যদি এই শিল্পে জড়িত হয়ে আয় রোজগার করতে পারে, তাহলে পরিবারে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পায়। তবে গার্মেন্টের চাকরি বিধিমালা পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কর্মীদের বেতন কাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের দেশের গার্মেন্টস মানেই হলো মালিক দ্বারা শ্রমিক শোষণ। এই শোষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে অবশ্যই সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

কৃষিতে নারী : গ্রামে বসবাসরত প্রতিটি নারীই নিজ নিজ পরিবারে কৃষি ও কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। প্রত্যক্ষভাবে কৃষি খামার কিংবা কৃষি জমিতে কাজ করা নারীর সংখ্যা কম হলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক নারীকে এই খাতে শ্রম দিতে হয়। পারিবারিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদার কারণে নারীরা নিজের ঘরে কিংবা খামারে পরিশ্রম করলেও তা প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন। গ্রামের প্রতিটি পরিবারে মা, স্ত্রী, কন্যা কোনো না কোনোভাবে কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত। কিন্তু ব্যাপারটি খুব একটা প্রকাশ্যে আসে না। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে, কৃষিতে এখন নারীর অংশগ্রহণের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জরিপের বছরে দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ১৩ লাখ। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৩ লাখ।

আমাদের দেশে মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। আর নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৭০ শতাংশ কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির হিসাব নেই। এমনকি কৃষি কাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়নও হয় না। তাদের এই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না বরং তারা সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন বানু বলেন, কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারলে কৃষিতে গ্রামীণ নারীরা আরও আগ্রহী হবেন। ফলে কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়বে, জিডিপিতে কৃষির অবদানও বাড়বে। তাই কৃষিকাজে জড়িত নারী শ্রমিকদের মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও তাদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারলে এ কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবেন এবং দেশে কৃষির উৎপাদন আরও বাড়বে।

বিদেশের শ্রমবাজারে নারী : বর্তমানে প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ নারী। এ হিসাবে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ১২ শতাংশ নারী।করোনার শুরু থেকেই স্থবিরতা বিরাজ করছে সব দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে। এর প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও। বিশ্বের বেশি কিছু শ্রম আমদানিকারক দেশ শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক দেশই প্রবাসী শ্রমিকদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে, দেশে ফিরে আসা শ্রমিকরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছেন ফিরে আসা নারী শ্রমিকরা। দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে আমাদের দারিদ্র্য কাটেনি। অর্থনীতি বড় হওয়ার পেছনে যাদের অবদান সর্বাগ্রে স্মরণীয়, তারা আমাদের প্রবাসী শ্রমিক। এই শ্রমিকরা জীবিকার টানে দেশ থেকে পাড়ি জমান অজানা গন্তব্যে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কর্মের জন্য বিদেশে যান। পরিবারে একটু সচ্ছলতা আনার জন্য গরু, বাছুর, জমি-জমা বিক্রি করে বিদেশে যান অনেকে। গ্রাম-বাংলার অনেক নারী তার বৈদেশিক আয় দিয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।

শ্রম শক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং তা হতে রোজগার আধুনিক কালে লক্ষণীয় যা পুরুষের কর্মক্ষেত্রের বিস্তারের সমসাময়িককালে বিকশিত হয়েছে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রের বৈষম্য নারীকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। সুদীর্ঘকালের ধর্মীয় ও শিক্ষাগত প্রচলন থেকে উদ্ভূত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ নারীকে আধুনিককালের পূর্ব পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করেছে। পুরুষের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং ফলশ্রম্নতিতে নারীর নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থান একই প্রভাব ফেলেছে, বিশেষভাবে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীজুড়ে পেশাদারি জীবিকার উদ্ভবের ফলে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে