মেয়েদের বিয়ের বয়স

কেন নারীদের কপালে বিস্ময় রেখা। যেখানে সরকারই বলছে- বাল্যবিয়ে বা শিশু বিয়ে বন্ধ কর, সেখানে সরকারই আইন করে দিচ্ছে প্রয়োজনে বা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কন্যাদায়গ্রস্ত মা-বাবা চাইলে ১৬ বছরেও বিয়ে হতে পারে। কিন্তু কোনো বিশেষ শর্ত দিয়ে কি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাবে না; এটাকে আরেকটি উপায়ে উসকে দেওয়া হচ্ছে? বিয়ের বয়স ১৮ বছর, তবে ক্ষেত্র বিশেষে ১৬ বছর করাটা একটা অনৈতিক ভাবনার পর্যায়ে কি পড়ে না?

প্রকাশ | ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

নাসরীন গীতি
এক কন্যার অনেক রূপ। সে কখনো জায়া, কখনো ভগ্নি। শান্ত-স্নিগ্ধ এই তন্বী রমণীরা। এক হাতে যেমন ঘরসংসার সামলান, তেমনি আবার হয়ে উঠেন বীরকন্যা। আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে বসেন মসনদেও। আধুনিকতার বিকাশে প্রগতিশীলতার কথা বলে নারী, সমাজ-রাষ্ট্রের একাংশ বিবেচনায় যদি বলি, এগিয়ে যাক নারী তার শিক্ষা-চিন্তা-চেতনা আর মননে। কিন্তু সম্প্রতি এসব কিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের নারীদের কপালে বিস্ময় রেখা এঁকে দিয়েছে আমাদের নতুন আইন। চলতি বছরের গত ২৪ নভেম্বর মেয়েদের বিয়ের বয়স ২১ রেখেই বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৬ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যে কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে বিয়ে দেয়া যাবে। এবার আসা যাক, কেন নারীদের কপালে বিস্ময় রেখা। যেখানে সরকারই বলছে- বাল্যবিয়ে বা শিশু বিয়ে বন্ধ কর, সেখানে সরকারই আইন করে দিচ্ছে প্রয়োজনে বা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কন্যাদায়গ্রস্ত মা-বাবা চাইলে ১৬ বছরেও বিয়ে হতে পারে। কিন্তু কোনো বিশেষ শর্ত দিয়ে কি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাবে না; এটাকে আরেকটি উপায়ে উস্কে দেয়া হচ্ছে? বিয়ের বয়স ১৮ বছর, তবে ক্ষেত্র বিশেষে ১৬ বছর করাটা একটা অনৈতিক ভাবনার পর্যায়ে কি পড়ে না? বাস্তবে আমাদের সমাজে এখনো বেশির ভাগ পরিবারেই সন্তানরা বলতে পারে না যে, তারা বিয়ে করবে বা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়েছে কিংবা বিয়ের বয়স হয়নি বা বিয়ে করবে না। বিয়ের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে পরিবার এবং মেয়েদের ক্ষেত্রেই এটা বেশি হচ্ছে। বিয়ে একটা চুক্তি। সেই সূত্রে বিয়ের বয়স ১৬ বছর হলে কিছু কিছু আইনের সঙ্গেও তা সাংঘর্ষিক হবে। যেমন- * চুক্তি আইন অনুযায়ী চুক্তি করার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর, তাই বর্তমানে ১৬ বছর বয়সে কেউ বিয়ে করলে এটা চুক্তি আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছুই নয়। পারিবারিক অধ্যাদেশ-১৮৮৫; মুসলিম পারিবারিক আইন-১৯৬১-তে মুসলিম নর-নারীর বিয়ের নূ্যনতম বয়স ছেলের ক্ষেত্রে ২১ ও মেয়ের ক্ষেত্রে ১৮-এর কথা বলা হয়েছে। তাহলে ১৬ বছরের এই আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে না? শিশু ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ এবং নারী ও শিশু অধিকার কর্মীরা সরকারের ভাবনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ১৮ বছর বয়সের আগে করো বিয়ে হওয়া উচিত নয়। কেননা, ১৮ বছরের আগে কেউ বিচার, বুদ্ধি-বিবেচনা-বোধসম্পন্ন হতে পারে না। তাছাড়া শরীরের গঠনও পরিপূর্ণতা পায় না। সাবালকত্বের বিবেচনায়ও একজন নারী বা পুরুষ ১৮ বছরের আগে ভোটাধিকার পান না। সরকারের ২০১১ সালের সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) বলছে, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়ে যায়। ১৯ বছরের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন কিশোরী গর্ভধারণ করছে বা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। গত জুলাই মাসে ইউনিসেফ ও যুক্তরাজ্য সরকারের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত গ্র্যান্ড সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছর বয়সের আগে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু 'বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৬' এর খসড়ার অনুমোদন শুধু নারীদের চোখে-মুখেই নয়, বিস্ময় জাগে যে কোনো সচেতন মানুষের চোখে-মুখেই।