বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের উন্নয়নে পেশাজীবী নারী

সংসারে-সমরাঙ্গনে যুদ্ধ কর দৃঢ়পণে / ভয়ে ভীত হইওনা মানব / কর যুদ্ধ বীর্যবান, যায় যাবে যাক প্রাণ / মহিমাই জগতে দুর্লভ। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তার কবিতায় কর্মক্ষেত্র ও সংসার জীবন নিয়ে যথার্থই বলেছেন। সেই প্রেক্ষাপটে নারী এখন কর্মজীবন ও সংসার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। অনেক ক্ষেত্রে তারা নীতি নির্ধারণী ভূমিকায় অবতীর্ণ। নিজের দক্ষতা যোগ্যতা প্রমাণ করে তারা সম্মানের আসনের অধিষ্ঠিত। একই সঙ্গে তারা নিয়োজিত মানুষের সেবায়। এমনই চারজন গুণী নারী প্রফেসর ডা. রওশন আরা বেগম, পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা, ব্যাংকার নাজমুন নাহার ও ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ওঠে আসে পেশাজীবী নারীর বিভিন্ন দিক। গ্রন্থনা : আবদুর রহমান মলিস্নক
নতুনধারা
  ১৬ মে ২০২২, ০০:০০

প্রফেসর ডা. রওশন আরা বেগম

বিশিষ্ট চিকিৎসক ও সমাজসেবী

দক্ষতা, যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় এক অনন্য নারী প্রফেসর ডা. রওশন আরা বেগম। নিজেকে উৎসর্গ করেছেন যিনি মানবতার সেবায়। স্বাস্থ্যসেবায় তিনি রেখে যাচ্ছেন নিরবচ্ছিন্ন অবদান। নিজ এলাকা মানিগঞ্জের গড়পাড়ায় গড়ে তুলেছেন সাহেরা-হাসান মেমোরিয়াল হাসপাতাল। নিজের উপার্জনের অর্থ দিয়ে তিনি হাসপাতাল পরিচালনা করেন। কর্মরত ছিলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান হিসেবে। তিনি অবস্ট্রেটিকস ও গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি ফার্টিলিটি ও স্টেরিলিটি সোসাইটি অব বাংলাদেশের মহাসচিব। স্বামী আব্দুর রশিদ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি।

ডা. রওশন আরা বলেন, নারীকে তার উন্নয়নের জন্য তাকেই এগিয়ে আসতে হবে। সারাদেশেই কমবেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ না হলেতো নারীর উন্নয়ন অগ্রগতি সেভাবে করা সম্ভব হবে না। বাল্যবিয়ের কারণেই মাতৃমৃতু্য ও শিশুমৃতু্যর ঘটনা ঘটে। অথচ মায়েরা এ ব্যাপারে নীরব থাকে। বা তারাই এতে সম্মত থাকে। তাই নারীরা যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাল্যবিয়ে বন্ধে এগিয়ে আসে।

মাতৃ মৃতু্যরোধ প্রসবপরবর্তী রক্তপাত রোধ, অতি অল্প খরচে বন্ধ্যা নারীদের চিকিৎসা এবং প্রসূতি সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে তার ১২টি গবেষণামূলক নিবন্ধ বিভিন্ন চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৫০ সালে তিনি বাংলাদেশে প্রথম ইয়ং গাইনকোলজিক্যাল অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারে ভূষিত হন।

তিনি বলেন, 'নারীদের ওপর সহিংসতা ঘটনা ঘটে। সেটা নারী-পুরুষ মিলেই প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। একজন চিকিৎসক হিসেবে সবার সুস্বাস্থ্য আর সুন্দর জীবন কামনা করি। আমাদের দেশের নারীদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। সংসার আর সন্তান প্রতিপালন ছাড়াও তারা মানবতার সেবায় অংশ নিতে পারে। নিষ্ঠা আর দক্ষতা অর্জন করলে কেউ কাউকে পেছনে ফেলতে পারে না।

সৈয়দা জান্নাত আরা

পুলিশ সুপার, কুড়িগ্রাম

এক সময় নারী পুলিশ সদস্যদের প্রতি মানুষের এক ধরনের কৌতূহল ছিল। সে কৌতূহল অনেক কমে এসেছে। সে কৌতূহলটা এখন আগ্রহে পরিণত হয়েছে। নারীরা যে কোনো সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে ছুটে আসে। নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় তাদের কথা বলতে পারে। যেটা একটা পুরুষ সদস্যের কাছে বলতে পারত না। ভুক্তভোগীরা যেন একটা আশা ভরসার জায়গা পেয়েছে। পেশাগত জীবনে এটা একটা ভালো লাগার দিক। কথাগুলো বলছিলেন বিশ্ব শান্তিরক্ষা মিশনে দু'দুবার দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দা জান্নাত আরা। যিনি বর্তমানে পুলিশ সুপার, কুড়িগ্রাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এসপি) হিসেবে কাজ করছেন সৈয়দা জান্নাত আরা। ২০০৩ সালে তিনি পুলিশ বাহিনীতে এএসপি হিসেবে যোগ দেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন এবং ২১তম বিসিএস পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। এছাড়া, জাপানের ইয়ামাগুচি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে

মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

পেশাগত জীবনে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী এই পুলিশ কর্মকর্তা নড়াইলে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মা, এক ভাই ও চার বোনের পরিবার। পুরো পরিবার আলোকিত উচ্চ শিক্ষায়। সৈয়দা জান্নাত আরা এইচএসসি পর্যন্ত নড়াইলেই পড়াশোনা করেন। কর্মসূত্রে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে তিনি সুদান এবং কঙ্গোতে কাজ করেছেন। কঙ্গোতে ডড়সবহ ঋচট (ঋড়ৎসবফ চড়ষরপব টহরঃ) এর কমান্ডার ছিলেন। এখন তিনি বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের নারী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ জুডো ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়া, বাংলাদেশ পুলিশ ভলিবল ক্লাবের

সেক্রেটারিও তিনি।

পেশাগত জীবনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই বলে তিনি জানান। পুলিশে চাকরি করার কারণে তিনি অনেক বেশি সেফটি ও সিকিউরিটি ভোগ করছেন। যেটি অন্য পেশায় এতটা নেই। তবে একজন নারী হিসেবে একটা চ্যালেঞ্জতো আছেই। স্বামী সন্তান পরিবার সব কিছু ব্যালান্স করার একটা চেষ্টা সব সময় করতে হয়। সকাল- দুপুর-রাত কখন কি রান্না হবে সেটা আমাকেই মাথায় রাখতে হয়। তিনি বলেন, নারীকে যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তাহলে সে অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হবে না। নিজের অধিকারটা সে বুঝে নিতে পারবে। নিজের সুরক্ষা

নিজেই করতে পারবে।

নাজমুন নাহার

ডিজিএম, রূপালী ব্যাংক লি.

রূপালী ব্যাংক একটা মাতৃসুলভ প্রতিষ্ঠান। আলহামদুলিলস্নাহ, আলহামদুলিলস্নাহ- খুব ভালোভাবে মানসিক প্রশান্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমি এ পর্যন্ত কোনো বৈরী আচরণ কিংবা অসহযোগিতা পাইনি। আমার উনিশ বছর চাকরি জীবনে প্রচুর সহযোগিতা পেয়েছি। সাপোর্ট পেয়েছি, কোনো বৈরিতা পাইনি ম্যানজমেন্ট লেভেল থেকে। কখনই কোনো বঞ্চনার শিকার হইনি।

কর্মজীবী নারী হিসেবে প্রথম দিকে খুব চ্যালেঞ্জ ছিল। আর ১০ জন কর্মজীবী নারীর ক্ষেত্রে যেটি হয়ে থাকে। দুটি বাচ্চা নিয়ে সংসার আর অফিস সামাল দেওয়া খুব কঠিন ছিল। সেক্ষেত্রে আমার হাজবেন্ড ও মায়ের বাড়ি থেকে আমি সাপোর্ট পেয়েছি। এখন ওরা বড় হয়ে গেছে। এখন সেরকম সমস্যা হয় না। যখন ওরা ছোটো ছিল কঠিন সময় পার করে এসেছি। সব কর্মজীবী মায়েদের এই কষ্টটা করতে হয়ে কমবেশি।

শিক্ষিত নারীরা যে যে ফিল্ডে কমফোর্ট ফিল করে। অবশ্য যেন কোনো একটা প্রফেসনে অ্যাঙগেজড হয়ে। শিক্ষাটা যেন সে কাজে লাগায়। সংসার নিয়েই যেন সে শুধু বসে না থাকে। কর্মজীবনের বিশাল একটা ফিল্ড এই ফিল্ডটা মিস করা ঠিক না। যার যার মতো করে পেশাগত জীবনে জড়িত থাকা। সারাজীবন যে লেখাপড়া করল যে অর্জনটা যে বিদ্যাটা সেটা কাজে লাগানো। অর্জন করলাম কাজে লাগলো না সেটাই হচ্ছে মেইন ফোকাস পয়েন্ট। তখন একটা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা অটোমেটিকেলি চলে আসে। সেই জীবনের শুরু থেকে মানে প্রথম থেকে একটি মেয়ে একটি ছেলের সঙ্গে ফাইট করে রেজাল্টটা বের করে নিয়ে এসেছিলাম। সেই অর্জনটাকে কী আমি বাক্সবন্ধী করে রাখব? সেই অর্জনটা কী আমি ব্যবহার করব না। সেটাতো এক দুদিনের জন্য না। ষোলো সতেরো বছরের একটা অর্জন সে অর্জনটা আমরা কাজে লাগাই। পেশায় যোগদান করলে কিছু সুবিধা আছে কিছু অসুবিধাও আছে। সেগুলো মেনে নিয়েই চলতে হবে। চাকরি করলে যে সবই ভালো তাতো না। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় বাচ্চাদের। খুব ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে হয়। লেখাপড়ার অর্জনতো একটা সাধনার ফল।

আমার জন্ম মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনিতে, অফিসার্স কোয়ার্টারে। বেড়ে ওঠা হচ্ছে রামপুরাতে। এসএসসি রামপুরা একরামুন্নেসা গার্লস স্কুল। এইচএসসি উইমেন্স কলেজে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে পাস করেছি। এরপর কর্মজীবনে প্রবেশ করি।

ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি

আইনজীবী, হাইকোর্ট

নারীদের জন্য আইন পেশা সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ সেটা আমার কাছে ফিল হয়েছে। ২০১৪ সালে যখন লোয়ার কোর্টে তখন নারীদের জন্য আলাদা একটা বাথরুম পর্যন্ত ছিল না। সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হয়ে একজন নারী যখন ১০টায় তার কাজ শুরু করেন শেষ করতে ৬টা বেজে যায়। এই লম্বা সময় অর্থাৎ ৮টা থেকে ৬টা পর্যন্ত কোনো ওয়াশরুম পর্যন্ত ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। ব্যবহারের একটা ছোট রুম দিয়েছে কিন্তু তা খুব অপ্রতুল। একটু রিলাক্স করা বা নামাজে পড়ার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। এখন কিছুটা করেছে। সেটাও খুব ভালো না। ওয়াশরুমটা খুব নোংরা হয়ে থাকে। একজন মহিলারতো ফিমেল হেলথ রিলেটেড প্রবলেম থাকে। তখন একটা নোংরা ওয়াশরুম ব্যবহার করা খুব দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

আদালতের পরিবেশ নারীবান্ধবও নয়। ফুল গাউন পরা ছিলাম একদিন। আইনজীবীর পোশাক পরা অবস্থায় একজন আসামি যাচ্ছেন, পুলিশ পাশে থাকা অবস্থায় আমাকে একটা কমেন্ট ছুড়ে দিলেন। পুলিশ অফিসার পাশে দাঁড়িয়ে হ্যা হ্যা করে হাসল। এটা প্রতিহত করার কেউ নেই। পুলিশ কর্তকর্তাকে যদি বলি আপনার সামনে এমন অশোভন উক্তি করল আপনি কিছুই করলেন না, এর প্রতিকার পাব না বলে কিছুই বললাম না।

এ পেশায় এসেছি মানুষের সেবা করতে। অনেক নারী ক্লায়েন্ট নিয়ে কাজ করি। আমি নারী বলেই একজন নারী তার সমস্যাটা ভালোভাবে আমার কাছে শেয়ার করতে পারে। নারী হিসেবে রিয়ালিস্টিক একটা সলিউশন দেই। যখন ওসব নারীদের হেল্প করতে পারি তখন নিজেকে সার্থক মনে হয়। পেশা আর সংসার ব্যালান্স করা খুব কঠিন। আমার দুটো বাচ্চা আছে একজন সাড়ে তিন বছর আরেকজন দেড় বছরের। যখন ছোট ছেলেটার জন্ম দেব তখন করোনা লকডাউনে চলে যাই। আমি তাই এখনো ফুলটাইম ওয়ার্কে ফিরিনি। এখন সন্তানকেই প্রায়োরিটি দিচ্ছি।

নারীদের প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে- আমার অধিকার আমাকেই চাইতে হবে। আরেকজন পুরুষ সেটা চেয়ে দেবে না। পুরুষ এমপি পার্লামেন্টে আমার অধিকারের কথা বলবে না। মেয়েদের তার সাধ্যের মধ্যে সব জায়গায় তালমিলিয়ে চলতে হবে। শিক্ষা এবং চেষ্টার

কোনো বিকল্প নেই।

নাসরিন সুলতানা মিলির শৈশব কেটেছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এলাকায়। ইংরেজি মাধ্যমে 'এ' লেভেল ও 'ও' লেভেল করেছেন। পড়ে আইন বিষয়ে পড়তে লন্ডন চলে যান। বার এট ল' করে ২০১৪ সালে দেশে ফিরে আইন পেশায় যুক্ত হন। তিনি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এক্সাম ফ্যাকাল্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হাইকোর্টের একজন আইনজীবী এবং কোম্পানি ল' প্রাকটিস করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে