মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

যারা সরাসরি অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল সবাের্পক্ষা বেশি। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যে কোনো ভ‚মিকায় অবতীণর্ হতে যাওয়াই ছিল ঝুঁকিপূণর্। আর সে ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক নিযার্তনের ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূণর্ বিষয়। এসব ঝঁুকি সঙ্গে নিয়েও দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী সশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের...

প্রকাশ | ১০ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ডা. তানজিনা আল্-মিজান
বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ দুইটি অবিচ্ছেদ্য শব্দ। বাঙালি জাতির হৃদয়ের গভীরের একটি শব্দ ‘মুুক্তিযুদ্ধ’। এই মুক্তিযুদ্ধ আসলে কি? পাকিস্তানি শাসকদের কাছে থেকেও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশ মাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য, জাতির অধিকার আদায় সবর্পরি একটি পতাকার জন্য এ দেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল আর ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা, একেই বলে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে কোনো দল বা গ্রæপের একক অবদান আছে এটা বলা যাবে না। কারণ কেবল প্রত্যক্ষ যুদ্ধই নয়, পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা ও সব শ্রেণিকে উদ্বুদ্ধ করা, বোমা তৈরিসহ গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ, সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অথর্, ওষুধ, খাদ্য, বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকাযর্ এবং আশ্রয়দান প্রভৃতি কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অজের্নর জন্য অবশ্য করণীয় ছিল। উল্লিখিত কমর্কাÐের যে কোনো একটি বাধাগ্রস্ত হলে যুদ্ধে জয় লাভ করা কঠিন হয়ে পড়তোÑ এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ কথা ঠিক এসব কাজে যারা সরাসরি অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল সবাের্পক্ষা বেশি। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে যে কোনো ভূমিকায় অবতীণর্ হতে যাওয়াই ছিল ঝঁুকিপূণর্। আর সে ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক নিযার্তনের ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূণর্ বিষয়। এসব ঝঁুকি সঙ্গে নিয়েও দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী স্বশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের। পাকিস্তানিদের হাতে প্রায় তিন লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল। আর নিযার্তনের শিকার হয়েছিল দুই লাখ নারী। সেই অগ্নিগভর্ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কিশোরী, তরুণী, প্রৌঢ়া এমনকি প্রবীণ অবিবাহিতা নারী ও বিবাহিত নারী কিভাবে তাদের ক্ষতবিক্ষত জীবন পার করেছেন তা কল্পনার অতীত। ববর্তার শিকার এই নারীদের কয়েকজন অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন। কেউ কেউ এসএসসি পাস থেকে শুরু করে এমএ পাস, এমনকি এমবিবিএস ডাক্তারও ছিলেন। যারা বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্যও নেই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এসব নারীদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক শ্রমজীবী নাসর্, সমাজসেবী, গৃহকমীর্, চাকরিজীবী, অধিকাংশই গৃহিণী। এসব নারীদের দু’একজন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের ভেতরে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারতে স্থাপিত হাসপাতালে নাসর্ হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন কয়েকজন। দেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পেঁৗছে দেয়ার ঝঁুকিপূণর্ কাজও করেছেন অনেকে। এই নারীরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এ নিয়ে বিতকের্র কোনো অবকাশ নেই। জাতির মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে পরিমাপ করা যাবে না। এই বিশালতায় যেসব নারী বিভিন্ন অবস্থানে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমÐিত করেছেন তাদের অনেকের নাম এখনো অজানা। তবে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীরা সারা দেশেই তৎপর ছিলেন। তারা বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষের বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন। মমতাজ বেগম, কাজী রোকেয়া সুলতানা, বেবী মওদুদ, রানী খান, রোকেয়া কবীর, মনিরা আক্তার প্রমুখ নারী জনমত গঠনের পাশাপাশি ফিজিক্যাল ফিটনেস, মাচর্-পাস্ট, অস্ত্র চালনা, ফাস্টএইড, ট্রেঞ্চ করা এবং আত্মরক্ষার নানা কৌশলÑ এসব ব্যাপারে ট্রেনিং নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা দিতেন। বদরুন্নেসা আহমেদ পুনবার্সন কাযর্কলাপ ও মহিলা সংগঠন মুজিবনগরের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন একাত্তরে। বেগম নুরজাহান খুরশীদ বিভিন্ন সেক্টরগুলোর কমর্কাÐ পরিদশর্ন ও রিপোটর্ আদান-প্রদানের কাজ করলেও পরবতীর্ সময়ে ক‚টনীতিকের দায়িত্বও পালন করেন। সাজেদা চৌধুরী তার বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। সেই সঙ্গে সচেতন করতেন কোন কোন বিষয়ে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে মহিলা মুক্তিফৌজের হাল ধরেছিলেন। এই মহিলা কমিটি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এই কমিটিতে প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ ছাড়াও গীতারানী নাথ, নিবেদিতা দাস, সুধারানী কর মঞ্জুদেবী, সুষমা দাস ও রমা রানী দাস এদের নাম উল্লেখযোগ্য। কাজের সুবিধাথের্ প্রশিক্ষণ সেবা ধাত্রী বিদ্যা, প্রাথমিক চিকিৎসা, কুটির শিল্প, মুদ্রণ ও রামকৃষ্ণ মিশন এরকম কয়েকটি সাব-ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কাজ করেছেন নারীরা। তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সেবার দায়িত্বে কানন দেবী, উপাসনা রায়, সুধারানী কর, পূণির্মা রানী দাস ও নিপা রানী মুজমদারের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ, সুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরো অনেকে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রেখেছেন। নাজিয়া ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে অনন্য ভ‚মিকা রেখেছে। সেলিনা বানু স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখাও শরণাথীের্দর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। এসব কাজে বেগম মুস্তারী সাফী, মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, রীনা খান প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং সক্ষম নর-নারীদের স¦াধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কমর্কাÐের খুবই গুরুত্বপূণর্ ভূমিকা ছিল। শাহনাজ বেগমের কণ্ঠেÑ সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, কল্যাণী ঘোষের পূবর্ দিগন্তে সূযর্ উঠেছে, এরকম আরো অজস্র গানের সুর শুনে মানুষ শিহরিত হয়েছে আর ঝঁাপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষার সংগ্রামে। প্রাণ বিষণœœ হতে পারে একথা জেনেও যেসব স্ত্রী, মাতা, ভগ্নি কন্যারা তাদের প্রাণপ্রিয় স্বামী, পুত্র, ভাই ও বাবাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন তাদের এই মহানুভবতার উৎসও অবশ্যই দেশপ্রেম। এ ক্ষেত্রে শেখ ফজিলাতুন্নেসার নাম সবাের্গ্র । এ ছাড়াও জাহানারা ইমাম ও বেগম সুফিয়া কামালসহ আরো হাজারো নাম না জানা নারী যোদ্ধারা ছিলেন। বেগম নূরজাহান মুরশিদ, আমেনা আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী ও মালেকা বেগম প্রমুখ এসব নারীরা পেশাদার ক‚টনীতিক না হলেও দেশের প্রয়োজনে তাদের সেই চরম মুহ‚তের্ এরকম গুরু দায়িত্বে অবতীণর্ হতে হয়েছিল।