মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশি বন্ধুকে আমরা পেয়েছি, তাদের মধ্যে অন্যতম ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি শুধু এক কোটি বাংলাদেশিকে আশ্রয় ও খাওয়া-পরার ব্যবস্থাই করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। আর বাংলাদেশের জন্য আন্তজাির্তক বিশ্বের সমথর্ন আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি মাকির্ন রক্তচক্ষুর বিপরীতে এক অনন্য অবস্থানও নেন তিনি...

প্রকাশ | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

সুমন্ত গুপ্ত
ইন্দিরা গান্ধী
মাতৃভ‚মি রক্ষাথের্ লড়াই করা বিরাট গৌরবের ব্যাপার। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার আপামর জনতার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই গৌরব অজের্নর সুবণর্সুযোগ হয়েছিল হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার। ১৬ ডিসেম্বর আমরা পেয়ে যাই আমাদের কাক্সিক্ষত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশ জন্ম নেয়; ‘বাংলাদেশ’। এই গৌরব অজের্নর এক বড় অংশীদার হচ্ছে বিদেশিরা। তাদের একান্ত সহযোগিতায় যুদ্ধ জয় ত্বরান্বিত হয়েছে। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রামে শুরু থেকেই বহিবিের্শ্বর নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা, নিযার্তন এবং একপেশে যুদ্ধের খবর কেউ পেঁৗছে দিয়েছিলেন কলম হাতে, কেউ ক্যামেরা হাতে। বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলেন নিজের কবিতায়, কেউবা গান গেয়ে। ডবিøউএএস ওডারল্যান্ড : ডবিøউএএস ওডারল্যান্ড একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সমরে বীরোচিত অংশগ্রহণের জন্য বীরপ্রতীক সম্মান লাভ করেন। তিনি খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকায় বাটা শু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ওডারল্যান্ড ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই কোম্পানি-ম্যানেজার ওডারল্যান্ড যেন নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেন নতুন এক যুদ্ধের মুখোমুখি প্রাক্তন সৈনিক ওডারল্যান্ডকে। অপারেশন সাচর্লাইটের সময় তিনি লুকিয়ে সে রাতের ভয়াবহতার কিছু ছবি তুলে পাঠান আন্তজাির্তক গণমাধ্যমে। আর এভাবেই তিনি বাংলাদেশিদের প্রাণের বন্ধু হয়ে ওঠেন। শুধু এ দেশের স্বাধীনতার জন্য আর নিরীহ মানুষকে হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিজের মানবিক তাড়নাতেই সবোর্চ্চ ত্যাগ স্বীকার করে লড়তে থাকেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। আগস্ট মাসের দিকে তিনি টঙ্গীতে বাটা শু কোম্পানির ভেতরে গেরিলা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও ওষুধ এবং আশ্রয় দিয়েও তিনি সাহায্য করেছিলেন। টঙ্গী ও এর আশপাশ এলাকায় বেশ কয়েকটি সফল গেরিলা হামলার আয়োজকও ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সাল পযর্ন্ত বাংলাদেশে কাজ করে অবসর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত যান বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ডবিøউএএস ওডারল্যান্ড, বীর প্রতীক। একমাত্র বিদেশি হিসেবে তাকে বাংলাদেশ সরকার এই খেতাবে ভ‚ষিত করেছে। মৃত্যুর পূবর্মুহ‚তর্ পযর্ন্ত অত্যন্ত গবর্ ভরে ও শ্রদ্ধাঘর্্য চিত্তে নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন তিনি। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পাথের্র এক হাসপাতালে ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইন্দিরা গান্ধী : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশি বন্ধুকে আমরা পেয়েছি, তাদের মধ্যে অন্যতম ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি শুধু এক কোটি বাংলাদেশিকে আশ্রয় ও খাওয়া-পরার ব্যবস্থাই করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। আর বাংলাদেশের জন্য আন্তজাির্তক বিশ্বের সমথর্ন আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি মাকির্ন রক্তচক্ষুর বিপরীতে এক অনন্য অবস্থানও নেন তিনি। বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য ভারতের বিরুদ্ধেও পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করলে সেখানেও এক হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের নিদের্শ দেন। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণাথীের্ক সেবাযতœ করায় ইন্দিরা গান্ধীর এ কাজকে যিশু খ্রিস্টের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সম্মাননা জানিয়েছে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর। ১৯৭১ এ ভারতের সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেন। তাদের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য সাহায্য করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবাদী অথচ নিরস্ত্র বাঙালিকে সাহস জোগান তিনি। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক,ৎ ও যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ভারতে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে একের পর এক গেরিলা যুদ্ধে পরাস্ত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়েই, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘পূবর্বাংলায় যা ঘটেছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকবে না।’ পরে ১৭ মে তিনি পশ্চিমবঙ্গ আসেন। কারণ সেখানেই সবচেয়ে বেশি শরণাথীর্ আশ্রয় নেয়। ৩০ এপ্রিল, ’৭১ ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেন। ৯ মে তাদের হাতে দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে আগ্রহী বাংলাদেশের তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্ব। এ ছাড়া শাসক পাকিস্তানিদের বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমথর্ন আদায়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সে সময় বিভিন্ন দেশ সফরও করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করেন ইন্দিরা গান্ধী। মাকির্ন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং সামরিক সাহায্য বন্ধের বিষয়ে অক্ষমতা জানালে ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেন, ‘ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহয়তা বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই।’ জজর্ হ্যারিসন ও পÐিত রবিশঙ্কর : ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট আয়োজিত কনসাটর্ ফর বাংলাদেশের নেপথ্যের মানুষটির নাম পÐিত রবিশঙ্কর, তার সঙ্গে ছিলেন ছাত্র জজর্ হ্যারিসন। ১ আগস্ট নিউইয়কের্র মেডিসন স্কোয়ার গাডেের্ন ওই কনসাটের্ সমবেত ৪০ হাজার হষোর্ৎফুল্ল দশর্ককে জজর্ হ্যারিসনের কণ্ঠে ধন্যবাদ জানানো এবং সূচনা পবের্ ভারতীয় সংগীত পরিবেশনার ঘোষণাটি স্থান পায়। প্রথমেই পÐিত রবিশঙ্কর ওই প্রোগ্রামটি বাংলাদেশের শরণাথীের্দর সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আয়োজিত এবং বাংলাদেশের ওই সময়কার ম্যাসেজটিও সবাইকে জানান। ওই কনসাটের্ বব ডিলান, এরিক ক্যাপটন, লিওন রাসেল, ব্যাডফিঙ্গার, বিলি প্রেস্টন ও বিটলসের রিঙ্গো স্টারের অংশগ্রহণে সম্ভবপর হয়েছিল। ‘কনসাটর্ ফর বাংলাদেশ’ থেকে সংগৃহীত হয়েছিল ২৪৩ হাজার ৪১৮ ডলার ৫০ সেন্টস। সত্তরে বিটল্স ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে ক্যারিয়ার গড়তে সে মনোযোগী হয়ে ওঠে। জজর্ হ্যারিসন যখন দ্য কনসাটর্ ফর বাংলাদেশ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন বিটল্সের সহশিল্পীদের সঙ্গে তার সম্পকর্ স্বস্তিকর ছিল না। তা সত্তে¡ও তিনি আত্মাভিমান ত্যাগ করে সহশিল্পী ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কনসাটের্ অংশ নেয়ার অনুরোধ জানান। জজর্ হ্যারিসন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই বলেন, ‘ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।’ দ্য কনসাটর্ ফর বাংলাদেশের বড় আকষর্ণ ছিলেন বব ডিলান ও জজর্ হ্যারিসন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জজর্ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।