শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গার্মেন্টশিল্পে নারী শ্রমিক

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত গার্মেন্ট। সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে যে শ্রমিকরা তারাই সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে থাকেন, অর্ধাহারে থাকেন, প্রায় অনিদ্রায় থাকেন। কারণ ১৭-১৮ ঘণ্টা কাজ করার পর দুই মাইল হেঁটে রান্না করে কিছু খাওয়ার পর ঘুমের সময় থাকে না। তার ওপর কাজ করেন মৃতু্য গুহায়। এই শিল্প খাত থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, তার কৃতিত্ব শতকরা ৯৯ ভাগ শ্রমিকদেরই, মালিকদের নয়। কারণ এই শিল্পে বিশেষ উন্নত প্রযুক্তি বা বেশি পুঁজি লাগে না। এই শিল্পের দ্রম্নত বিকাশের মূলে রয়েছে মানুষের শ্রম, বিশেষ করে কম বয়সি মেয়েদের শ্রম, যাদের ওপর চলে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। এই বর্বরতা আমাদের জাতিকে বিশ্ব দরবারে বড়-ছোট করে দিয়েছে।
হায়দার খান
  ০১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ভ্যাটিকানের পোপ বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরির কথা শুনে বিস্মিত, দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এ যেন দাসশ্রম। মানবিক কারণে মজুরি বৃদ্ধির আবেদন তিনি জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪ জন কংগ্রেস সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। রানা পস্নাজায় ভবনধস ও তাজরিনের অগ্নিকান্ডে শ্রমিক হত্যা ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যা রহস্যের কোনো সুরাহা না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। সেও বেশ আগের কথা।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা যে প্রাচীন যুগের দাস শ্রমিকদের মতোই- যাদের আগুন লাগার পর গেট বন্ধ করে হত্যা করা যায় এবং ভবন ধসে পড়বে জেনে জোর করে কাজে বাধ্য করে হত্যা করা যায়। একথা আমরা জানলেও বিদেশিরা হয়তো এমনভাবে জানতেন না। এখন জেনেছেন। আমরা প্রতিবাদ করলে অতি মুনাফাখোর গার্মেন্ট মালিকরা তাকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। সরকারেরও কর্ণকুহরে তা প্রবেশ করে না। বিদেশিরা বিশেষ করে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বললে হয়তো খানিকটা টনক নড়ে। কিন্তু এত বলা-কওয়ার পরও যেমন মালিক, তেমনই সরকার প্রায় নির্বিকার থাকে।

কারণ এই মালিকদের কাছে মুনাফাই হলো একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। মানসিকতার লেশমাত্র নেই। আইন-কানুনকেও তারা পাত্তা দেয় না। কারণ পার্লামেন্টে রয়েছে প্রায় ৩০ জনের মতো সংসদ সদস্য যারা সরাসরি গার্মেন্ট মালিক। আর দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গার্মেন্ট মালিকদের টাকায় চলে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত গার্মেন্ট। সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে যে শ্রমিকরা তারাই সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে থাকেন, অর্ধাহারে থাকেন, প্রায় অনিদ্রায় থাকেন। কারণ ১৭-১৮ ঘণ্টা কাজ করার পর দুই মাইল হেঁটে রান্না করে কিছু খাওয়ার পর ঘুমের সময় থাকে না। তার ওপর কাজ করেন মৃতু্য গুহায়। এই শিল্প খাত থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, তার কৃতিত্ব শতকরা ৯৯ ভাগ শ্রমিকদেরই, মালিকদের নয়। কারণ এই শিল্পে বিশেষ উন্নত প্রযুক্তি বা বেশি পুঁজি লাগে না। এই শিল্পের দ্রম্নত বিকাশের মূলে রয়েছে মানুষের শ্রম, বিশেষ করে কমবয়সি মেয়েদের শ্রম, যাদের ওপর চলে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। এই বর্বরতা আমাদের জাতিকে বিশ্ব দরবারে বড়-ছোটো করে দিয়েছে।

মহামতি কার্ল মার্কস তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'পুঁজি'-এর প্রথম খন্ডে লিখেছিলেন :

'যথেষ্ট মুনাফা পেলে পুঁজি খুবই তেজি হয়ে ওঠে। ১০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানতে সে যে কোনো জায়গায় নিজেকে নিয়োগ করবে; ২০ শতাংশ নিশ্চিত জানলে নিয়োগের আগ্রহ প্রবলতর রূপে দেখা দেবে; ৫০ শতাংশ সুনিশ্চিত হলে দেখা দেবে স্পর্ধা আর মুনাফা যদি শতকরা ১০০ ভাগে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা থাকে তবে তার জন্য মানব সমাজের সমস্ত আইনকে পদদলিত করতে সে রাজি। আর যদি সে বোঝে মুনাফা ৩০০ শতাংশ পৌঁছাবে তবে এমন কোনো অপরাধ নেই যা করতে সে দ্বিধান্বিত হবে না। এমন কোনো ঝুঁকি নেই যা সে নিতে পারবে না। এমনকি যদি তার ফলে পুঁজি প্রভুর ফাঁসি হয় তাতেও সে রাজি।'

সাধারণভাবে পুঁজিবাদ সম্পর্কে মার্কস যে কথা লিখেছিলেন, তা বাংলাদেশের গার্মেন্টের ক্ষেত্রে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এখানে মুনাফার হার এত বেশি যে, মুনাফাখোর মালিকরা এমন কোনো অপরাধ নেই যে তা করতে দ্বিধান্বিত হয় না। হত্যা পর্যন্ত। আগুন লাগলে বাইরে বের হওয়ার গেট বন্ধ রাখা তো হত্যা শুধু নয়- গণহত্যার শামিল। ভবন ধসে পড়বে জেনে ব্যাংক কর্মচারীদের ছুটি দেয়া হলেও, গার্মেন্ট শ্রমিকদের জোর করে ভয় দেখিয়ে কাজে ঢুকানোর মতো ঘটনাকে হত্যা ছাড়া আর কি বলব। জেনেশুনে হত্যার মতো অপরাধ করতে সাহস পায় কীভাবে? এর উত্তর মার্কসের কথাতেই পাওয়া যাবে- অতিরিক্ত মুনাফার সম্ভাবনা থাকলে এমন কোনো অপরাধ নেই যা সে করতে পারবে না; এমনকি যদি তার ফলে পুঁজি প্রভুর ফাঁসি হয় তাতেও সে রাজি।

এ ছাড়া মালিকরা এত ঔদ্ধত্য হতে পেরেছে তার কারণ এই যে, সে জানে শত অপরাধ করলেও তার শাস্তি হবে না। কারণ সরকার তার পক্ষে। সরকার শ্রমিকবিদ্বেষী। এই ভরসায় তার ব্যাপক হত্যার মতো অপরাধ করতে সামান্যতম দ্বিধা করে না।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের শ্রমদাস কেন বলা হচ্ছে- তার কয়েকটি কারণ এখানে উলেস্নখ করা যেতে পারে:

প্রথমত, মজুরি। বর্তমানে শ্রমিকরা নিম্নতম মজুরি পায়। মালিকরা যেখানে সামান্য অসুখে সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউইয়র্কে কোটি টাকা খরচ করে চিকিৎসা করে সেখানে শ্রমিকের জন্য সামান্য চিকিৎসা ভাতা কতটা বৈষম্যমূলক তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না।

আমরা আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছি। সেখানে বলা আছে, একজন শ্রমিকের নূ্যনতম প্রয়োজন কী এবং মজুরি সেই অনুসারে নির্ধারণ করতে হবে। কত ক্যালরি খাদ্য দরকার, কতটা সাবান দরকার (শ্রমিকের জন্য সাবান জরুরি), এক পরিবারের জন্য প্রয়োজন কী কী- সবই সেই কনভেনশনে বলা আছে। বাজারদর হিসাব করলে এবং আইএলওর নিয়ম মানলে নিম্নতম মজুরি মাসে খুব কম করে হলেও ১৫ হাজার টাকার নিচে হবে না।

আরও হিসাব উলেস্নখ করি। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের আমলে নূর খান যে নূ্যনতম মজুরি ঘোষণা করেছিলেন সব শ্রমিকের জন্য তা ছিল মালিক ১২৫ টাকা- যা দিয়ে তখন ৫-৬ মণ চাল কিনতে পাওয়া যেত। সেটাকেও যদি স্ট্যান্ডার্ড ধরি, তাহলেও এখন বেসিক মজুরি কত হয়?

দ্বিতীয়ত, শ্রম দিবস। আমাদের দেশের আইনে আছে যে, শ্রম দিবস হবে আট ঘণ্টা। কয়েক বছর আগে মালিকরা সরকারের কাছে আবদার করেছিল, (যেন মামাবাড়ির আবদার) শ্রম দিবসকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করা হয়। যেখানে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতেই সংগ্রাম করে এই অধিকার আদায় করেছিল, যেখান থেকে মহান মে দিবসের উদ্ভব, সেখানে আমাদের দেশের মালিকরা কীভাবে শ্রম দিবস বর্ধিত করার কথা বলতে পারে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। কত মূর্খ, কত ছোট মনের, কত বর্বর এই মালিকগোষ্ঠী। তবে আইনে যাই লেখা থাকুক না কেন, মালিকরা কিন্তু ব্যতিক্রমহীনভাবে শ্রমিকদের আট ঘণ্টার অনেক বেশি খাটায়। অবশ্য ওভারটাইম বলে একটা কথা আছে। কিন্তু আইনে তিনটি শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে। (১) শ্রমিকের সম্মতির ভিত্তিতেই কেবল ওভারটাইম কাজ হতে পারে। (২) কিন্তু কোনো অবস্থাতেই দুই ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম হতে পারবে না। (৩) ওভারটাইমের জন্য দ্বিগুণ হারে মজুরি দিতে হবে। ব্যতিক্রমহীনভাবে সব মালিক এই আইন অমান্য করে চলেছে। কিন্তু সেজন্য আজ পর্যন্ত একজন মালিকেরও জেল-জরিমানা হয়নি।

তৃতীয়ত, কারখানার নিরাপত্তা। সাভারের গণহত্যার পর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু মালিকদের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মাত্র দুটি ঘটনাই মালিকের পৈশাচিক মনোভাব বোঝার জন্য যথেষ্ট। আগুন লাগার সময় গেট কেন বন্ধ থাকবে? শুধু একবার নয়, একাধিকবার এই ঘটনা দেখা গেছে। এত ঠান্ডা মাথায় খুন। বিগত এক দশকে অনেক আগুন লাগার ঘটনায় দুই সহস্রাধিক শ্রমিক খুন হয়েছেন। সব কটির ক্ষেত্রেই বাইরে বের হওয়ার গেট বন্ধ ছিল। সাভারের রানা পস্নাজা ধসের ঘটনাটিকেও গণহত্যা বলছি। কারণ আগের দিন ভবনে ফাটল দেখা দেয়া সত্ত্বেও অমানুষ কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের জোর করে কাজে ঢুকিয়েছিল। ওই ভবনে একটি ব্যাংক ছিল। কর্তৃপক্ষ ব্যাংক কর্মচারীদের ছুটি দিয়েছিল। কিন্তু রানা পস্নাজার মালিক ঘোষণা দেয় যে যারা কারখানায় আসবে না, তাদের তিন দিনের বেতন কাটা হবে। তারপর ভবন ধসের আশঙ্কায় ভীত শ্রমিকদের লাঠি দেখিয়ে কারখানায় ঢোকানো হয়েছিল। একে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ছাড়া আর কী বলব? সরকার ও মালিকগোষ্ঠী শ্রমিকদের যেন মানুষই মনে করে না।

চতুর্থত, গার্মেন্টশিল্পে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নেই। অথচ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত অধিকার। আসল কথা হলো এই যে, আমাদের দেশের এই নব্য ধনিক, যাদের অধিকাংশ আবার গার্মেন্টেরও মালিক তারা এখনো আধুনিক বুর্জোয়া পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের শিক্ষাদীক্ষা এবং সাংস্কৃতিক মানও খুব নিচু। তাই তারা ট্রেড ইউনিয়ন মানতে চায় না। কিন্তু সরকারকে তো ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মালিকের স্বার্থ রক্ষাকারী বুর্জোয়া সরকারও গণবিরোধী শ্রমিকবিদ্বেষী দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও ফ্যাসিস্ট চরিত্রের। এ কথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই বৈধ ট্রেড ইউনিয়নের পথ বন্ধ। কর্তৃপক্ষ জানে না যে, সংগ্রামের বৈধ পথ বন্ধ করলেই সংগ্রাম বন্ধ থাকে না। বাঁধ দিয়ে প্রবল জোয়ারের স্রোতকে ঠেকানো যায় না। তাই গার্মেন্টশিল্প এলাকায় বারবার শ্রমিক অভু্যত্থান ঘটছে।

নির্যাতন-নিপীড়নকে তুচ্ছ জ্ঞান করে শ্রমিকরা যে মহান বিদ্রোহের পথ দেখিয়েছিলেন, সেই পথেই শ্রমিক তার মুক্তি অর্জন করবে এবং সেটা করবে গণহত্যাকারী বর্বর মালিক শ্রেণিকে পরাভূত করেই। এই শ্রমিক শ্রেণি বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা এই পর্যন্ত যে ধরনের বিপস্নবী সম্ভাবনার পরিচয় তুলে ধরেছে, তাতে আমি আনন্দিত আশান্বিত। নতুন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ রচনা করবে এই বিপস্নবী নারী শ্রমিক শ্রেণি। লুটেরা-বুর্জোয়ার কবরের পরে তারা রচনা করবে সমাজতন্ত্রের ভিত্তি। নারী শ্রমিকদের কারণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সেই দিকেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে