নারীর জন্য নিরাপদ নয় গণপরিবহণ

প্রকাশ | ০৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

মালেকা আজম
নারীর জন্য নিরাপদ নয় গণপরিবহণ। নারী যাত্রীদের অনেকেই বলছেন, রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে পরিবহণ সংশ্লিষ্ট লোকজন কিংবা পুরুষ যাত্রীদের দ্বারা শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তারা। একদিকে নিরাপত্তা নিয়ে আস্থাহীনতা অন্যদিকে সামাজিক অসচেতনতার কারণে দিন দিন নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা বেড়েই চলেছে। নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃশ্যমান তৎপরতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নারীদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই। রাত নয়টায় ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত রিমা ইসমাত। মোহাম্মদপুর থেকে তার গন্তব্য বেড়ি বাঁধ পার বসিলা। এলাকাটা বেশ নির্জন। তাই রিমা ইসমাতও বাসে ওঠেন নানা হিসাব-নিকাশ করে। আমি বাসে উঠি। যদি দেখি অনেকে নেমে যাচ্ছে এবং যাত্রী খুব কম তখন আমিও নেমে যাই। কারণ সবসময়ই একটা ভয় কাজ করে। তার আশঙ্কা রাতের যাত্রায় নির্জন রাস্তায় যৌন হেনস্তার শিকার হতে পারেন তিনি। এমন আশঙ্কার ভিত্তিও আছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গণপরিবহণে নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন হওয়ার অনেক ঘটনাই সামনে এসেছে। রাতে নিরাপত্তা বলতে পুলিশের টহল। দূরপালস্নার বাসগুলোয় রাতের বেলায় যেসব নারী যাত্রী ভ্রমণ করেন তাদের জন্য কি নিরাপত্তা আছে? রাজধানী থেকে যশোরগামী একটি বাসের চালক অবশ্য জানালেন, তাদের বাসে নারী যাত্রীরা যথেষ্ট নিরাপদ। আমাদের বাসে যদি একলা মহিলা যাত্রী থাকে। তাহলে আমরা চেষ্টা করি, তার পাশের সিটে একজন মহিলা যাত্রী দেওয়ার। তবে বাসে খোদ পরিবহণ সংশ্লিষ্টরাই অনেক সময় ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ান। চলন্ত বাসে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এর জন্য বাসের চালক হেলপাররাই দায়ী। পুরো দেশই নারীবান্ধব হতে হবে। না হলে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। এর আগে রূপা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি ছিল বেশ আলোচিত। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনায় গণপরিবহণে নারীর অনিরাপদ চলার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গণপরিবহণে নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র। নিপীড়ক-নির্যাতক-ধর্ষকদের দ্রম্নত বিচার আদালতে বিচারের দাবি জানিয়েছেন নারীনেত্রী, মানবাধিকার কর্মী ও গবেষকরা। সেই সঙ্গে পরিবার থেকেই ছেলেশিশুদের মগজে-মননে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সম্মানবোধ ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার পরামর্শ তাদের। গণপরিবহণ ব্যবহারকারী নারীদের ওপর পরিচালিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক' গবেষণা অনুযায়ী, গণপরিবহণে হয়রানির শিকার ৯৪ শতাংশ নারী। এর মধ্যে বিচার পাবেন না জেনে কোনো প্রতিবাদ করেন না ৮১ শতাংশ। আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যান ৭৯ শতাংশ। অ্যাকশন এইডের জরিপ অনুযায়ী, বাসে পুরুষ যাত্রীদের মাধ্যমে ৪২ শতাংশ ও পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৩ শতাংশ নারী যাত্রী। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির জরিপ অনুযায়ী, গত বছর গণপরিবহণে ৫২টি ঘটনায় ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৫৯ নারী। ধর্ষণ, যৌন হয়রানির কারণে অনিরাপদ দেশের গণপরিবহণ ব্যবস্থা। কখন, কার ওপর পৈশাচিক হামলা হবে- এমন আতঙ্ক নিয়েই গণপরিবহণ ব্যবহার করছেন নারী যাত্রীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর মেসবাহ কামাল বলেছেন, রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান নারী হলেই সবকিছু নারীবান্ধব হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়; পুরো বিশ্বেই। যাত্রাপথে নারীদের যে পরিমাণ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ বিষয়টি কখনোই অনুধাবন করতে পারবেন না। পরিবহণ মালিকরাও নারীর সুবিধার প্রতি সেন্সেটিভ নয়। দুর্ভাগ্য রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এবং নারী সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। ফলে যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন সবাই কথা বলেন; কিন্তু কিছুদিন পরই আলোচনা সমালোচনা থেমে যায় এবং অপরাধীরা অপরাধে তৎপর হয়ে ওঠে। আইন হয় কিন্তু আইনের প্রয়োগ খুবই কম। অন্যদিকে আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকরে অপরাধীরা পার পেয়ে যায় এবং অপরাধ করতে সাহস পায়। এ ব্যাপারে নারীনেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর বলেছেন, ধর্ষণের মামলায় বিচার হয় মাত্র ৩ শতাংশ, এর মধ্যে নির্যাতনের শিকারের পক্ষে রায় হয় শূন্য দশমিক চার ভাগ। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় সাক্ষ্য দিতে চান না অনেকেই। অনেকেই মনে করেন, কেবল গণপরিবহণে নয়, ঘরে-বাইরে অনিরাপদ নারী। গণপরিবহণগুলো নারীবান্ধব নয়। গণপরিবহণে ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের হয়রানি করার অপেক্ষায় থাকে যৌন নিপীড়করা। নানা ধরনের বাজে নোংরা মন্তব্য ছুড়ে দেয়। বাসে ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত হেনস্তার শেষ নেই। বাসে ওঠার সময় গায়ে হাত দেয়, ভাড়াও চাইবে গায়ে হাত দিয়ে। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের গণপরিবহণ ছাড়া উপায় নেই। শুধু গণপরিবহণেই নয়, রাস্তাঘাটে হাঁটাচলাও নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। তবে গণপরিবহণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন নয়। নারীবান্ধব ট্রান্সপোর্ট পলিসির কথা না ভেবে যান্ত্রিকভাবে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি। আমাদের মানসিকতায়ও সমস্যা রয়েছে। নারীকে আমরা অবস্থার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করি। উচ্চবিত্ত নারীকে যেভাবে দেখি নিম্নবিত্ত নারীকে সেভাবে সম্মান করি না। দিন দিন এই অপরাধ বাড়ছে। এক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি ও অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।