নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে নারী

গ্রামীণ নারীরা সহজ-সরল। তারা সারাদিন কেবল হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে। জীবনেও মোটা অঙ্কের টাকার মুখ দেখেনি। ফলে এক সঙ্গে পাঁচ বা ১০ হাজার পেয়ে তারা অনেকটা দিশেহারা হয়ে যায়। অনেকের স্বামী আবার ঋণের টাকার ওপর ভাগ বসায়। আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য স্ত্রীর কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে যায়। একদিকে স্বামী প্রদত্ত চাপ, অন্যদিকে এনজিও কর্মকর্তার চাপ- দুই চাপে গ্রামীণ নারীরা অসহায় হয়ে পড়ে। অথচ কিস্তি পরিশোধের ব্যাপারে স্বামীর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যেসব এনজিও গ্রামীণ দরিদ্র নারীকে ঋণ দেয় তারা কখনই ভাবে না যে, প্রতি সপ্তাহে তারা এ ঋণ পরিশোধ করবে কী করে

প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ম আজমেরী সুলতানা
নারীর স্বাধীনতা অর্জনের একটি উলেস্নখযোগ্য দিক হলো স্বাবলম্বিতা অর্জন বা নিজের পায়ে দাঁড়ানো। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর স্বাবলম্বী বা আত্মনির্ভরশীল হওয়া মানে এক কঠিন সংগ্রাম ও সাধনার ব্যাপার। নারী এ পথে পা বাড়ালে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। নারী স্বাবলম্বী হওয়ার দুটি প্রধান দিক রয়েছে- একটি হচ্ছে নিজ যোগ্যতাবলে চাকরি বা ব্যবসা করা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে অন্যের সাহায্য নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। অন্যের সাহায্য বলতে ব্যাংক অথবা ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে কিংবা যে কোনো বেসরকারি সংস্থার ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া। এ কাজটি অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। নারী এতটাই পুরুষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও নির্যাতিত যে, এ ভয়াবহ জীবন থেকে মুক্তি চায় সে প্রতিনিয়ত। এ মুক্তির প্রধান দিক হচ্ছে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নারীর স্বনির্ভরতা অর্জন ইদানীং গণজোয়ারে পরিণত হয়েছে। এনজিওর মাধ্যমে সারাদেশব্যাপী চলছে এ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি। নারীরাও আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য বাছবিচার না করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এ কর্মসূচিতে। প্রশ্ন উঠতে পারে এনজিওর টাকা নিয়ে বিত্তহীন মহিলারা কী করে। উঠানে জমি থাকলে কেউ শাকসবজির আবাদ করে, কেউ গরু, ছাগল কেনে, কেউ সেলাই মেশিন কেনে, কেউ বাড়ির আঙিনায় গাছ লাগায়, আবার কেউ রাস্তার মোড়ে মুদি দোকান দেয়। হাঁস-মুরগি, কবুতর পালে কেউ। কেউ মুড়ি ভাজে। কেউ পুকুরে মাছচাষ করে। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের মাধ্যমে যে পেশাই গ্রহণ করুক না কেন, প্রত্যেকেরই সপ্তাহ শেষে উচ্চ সুদসহ কিস্তি গুনতে হয়। অবাক ব্যাপার যে সুদের হার কত তা ঋণ গ্রহীতারা জানে না। তারা দেখে, তারা সপ্তাহ শেষে এক বা দুশো টাকা পরিশোধ করছে। যে গাভী পালছে সে দুধ বিক্রি করে পরিশোধ করছে, যে হাঁস-মুরগি পালছে, যে ডিম বিক্রি করছে, যে দোকান চালাচ্ছে সে হয়তো দোকান থেকে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করছে। এমনও অনেক নারী রয়েছে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দৈনন্দিন সংসার খরচ মিটিয়েছে অথবা ব্যবসা করতে গিয়ে লোকসান দিয়েছে তারা কীভাবে কিস্তি পরিশোধ করবে। ঋণ দেওয়ার আগে এনজিওদের কঠিন ও অনিবার্য শর্ত হচ্ছে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা। যেসব নারী বিভিন্ন কাজে তাদের আর্থিক পারিবারিক উন্নয়নের নামে ঋণ নিয়েছে, এনজিওর মাঠকর্মীরা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার মতো সকালে, বিকালে দুপুরে তাদের খোঁজ রাখে। মধুর ব্যবহার করে প্রথম। ঋণ সফলভাবে পরিশোধ করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার ঋণ নেওয়ার তাগিদ দেয়। কিন্তু যে নারী ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করতে পারেনি, মুহূর্তে তার ওপর নেমে আসে অত্যাচার নির্যাতনের খড়গ। ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে যে নারী একবার পড়েছে, তার আর রক্ষা নেই, তার জীবন বিপন্ন হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ গরিবকে আরও গরিব করে এমন বহু প্রমাণ রয়েছে। ঋণ নেওয়ার পর কিছুদিন তার মধ্যে নগদ টাকার প্রাপ্তির উন্মাদনা থাকে, তখন নিজেকে সচ্ছল মনে হয়। আসলে এটা অর্থের গোলকধাঁধা। এ ধাঁধায় যে পড়েছে তার বের হয়ে আসা কঠিন। ঋণ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে ঋণের কিস্তি শোধের পালা এসে যায়। ঋণ গ্রহণের পর লাভ-লোকসানের হিসাব কেউ করে না। তারা যে কিস্তি পরিশোধ করে তা অনেকাংশ মজুর খাটার মতোই। অর্থাৎ সারাদিন গতর খেটে কিস্তির টাকা জোগাড় করতে হয়। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। যারা দুটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে, তাদের বিপদ বেশি। তারা এ ঋণ পরিশোধ করার জন্য ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পরিশ্রমের ফল হয় শূন্য। কারণ ঋণ পরিশোধ করতেই তাকে হিমশিম খেতে হয় বাড়তি আয়ের মুখ দেখবে কীভাবে। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়। প্রতি সপ্তায় ১০ টাকা করে বাধ্যতামূলক সঞ্চয় খাতে টাকা জমা দিতে হয়। গ্রামীণ নারীরা সহজ-সরল। তারা সারাদিন কেবল হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে। জীবনেও মোটা অঙ্কের টাকার মুখ দেখেনি। ফলে এক সঙ্গে পাঁচ বা ১০ হাজার পেয়ে তারা অনেকটা দিশেহারা হয়ে যায়। অনেকের স্বামী আবার ঋণের টাকার ওপর ভাগ বসায়। আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য স্ত্রীর কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে যায়। একদিকে স্বামী প্রদত্ত চাপ, অন্যদিকে এনজিও কর্মকর্তার চাপ- দুই চাপে গ্রামীণ নারীরা অসহায় হয়ে পড়ে। অথচ কিস্তি পরিশোধের ব্যাপারে স্বামীর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যেসব এনজিও গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের ঋণ দেয় তারা কখনই ভাবে না যে, প্রতি সপ্তাহে তারা এ ঋণ পরিশোধ করবে কী করে। এনজিওর পক্ষ থেকে বলা হয়, ঋণ নিয়ে বিত্তহীন নারীর জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, কন্যাদায়গ্রস্তরা অনায়াসে মেয়ে বিয়ে দিতে পারছে, বয়স্করা পর্যন্ত শিক্ষা পাচ্ছে, আরও কত কী? কিন্তু এ চিত্র কি টেকসই এবং সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত? আরও বলা হয় তাদের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কারিগরি দক্ষতা অর্জনের জন্য আগে প্রশিক্ষণ এবং তারপর ঋণ দেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রশিক্ষণ পেলেই কি সে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধের দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করে। গ্রামীণ নারী জানে না, তাদের ঋণের টাকার সুদ কত। যদিও বলা হয় শতকরা ১৫ ভাগ, আসলে এ সুদ গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ থেকে ৪০ ভাগে। যেমন একজন নারীর নিজের পুঁজি রয়েছে ৩০ হাজার, এনজিওর কাছ থেকে বাকি ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে যদি সে একটি দুধেল গাভী কেনে তবে তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। অর্থাৎ শতভাগ এনজিওর ঋণ নিয়ে কোনো নারীর পক্ষে আত্মনির্ভরশীল হওয়া কঠিন। তবে যেসব নারী সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দিয়েছে তারাই সাফল্যের মুখ দেখেছে। অথবা যার ১০ কাঠা বা এক দুই বিঘা জমি রয়েছে, রয়েছে একাধিক পুকুর। তারা ঋণ নিয়ে শাকসবজি ফলিয়ে পুকুরে মাছ চাষ করে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে। এখানে একটি কথা স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন যে, শতভাগ এনজিও নির্ভরশীল হয়ে ঋণ নিলে তার পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গরিব যে আরও গরিব হয়ে যায়, তার প্রধান কারণ নিজের কোনো অর্থ-বিত্ত না থাকা সত্ত্বেও ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা। কেবল এনজিওর ঋণে কোনো নারীর পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ নয়। যেমন একজন নারী এনজিওর ঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগি, কবুতর পালন করছে বা মুড়ি ভেজে হাটবাজারে বিক্রি করছে তার অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যে রাস্তার মোড়ে মুদি দোকান দিয়েছে কিংবা পরপর দুইবার দুই এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গাভী বা ছাগল কিনেছে তার অর্থনৈতিক ঝুঁকি রয়েছে। তবে উত্তরবঙ্গের নারীরা বেশি কর্মঠ ও কর্তৃত্বপরায়ণ। তারাই সংসার পরিচালনা করে। নিজেরাই মাঠের কাজ করে। বেশ কজন গ্রামীণ নারীর কথা আমি জানি, তারা ঋণ নিয়ে এক দশক ধরে সংগ্রাম করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যেমন লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগরের বুলবুলি, মোঘলাহাটের হাজেরা, ঠাকুরগাঁওয়ের পদমপুরের সোনাবালা, নীলফামারী জেলার সোনারায় গ্রামের তাহেরা। এরা এনজিও থেকে ঋণ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মোন্নয়নের ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য এনেছে। এরা হাজারে একজন। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন বা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রে এরা উদাহরণ হতে পারে না। তবে এনজিওদের কারসাজি অন্য জায়গায়। তারা হাজারে একজন নারীর সাফল্যকে মডেল হিসেবে দাতাগোষ্ঠী বা মিডিয়ার সামনে দাঁড় করায়, বাকি ৯৯৯ জন পড়ে থাকে অন্ধকারে। মিডিয়াকে ঘুষ অথবা উপঢৌকন দিয়ে ওই একজনের সাফল্যকে মহাসাফল্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারেও ওই আত্মনির্ভরশীল নারীকে হাজির করা হয়। এর ফলে দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ফান্ড পেতে সুবিধা হয়। এটাও এক ধরনের প্রতারণা। এনজিওগুলোর প্রতারণা আর লোভের ফাঁদে পড়ে এ দেশের দরিদ্র নারী আরও হতদরিদ্র হয়েছে। নারী ঋণের মাধ্যমে অর্থ নিয়েছে কিন্তু আত্মনির্ভরশীল হতে পারেনি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এনজিরও ঋণ নিয়ে নারীর আত্মনির্ভরশীল হওয়া খুবই কঠিন। এটা হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বপ্নময় প্রলোভন ও শোষণজনিত ফাঁদ। এ ফাঁদে নারী একবার পড়লে তার আর রক্ষা নেই। একবার ফাঁদে পড়া বা ঋণের জালে আবদ্ধ হওয়া মানে, বারবার পড়া। এর ফলে একজন নারীর জীবন-সংসার হয়তো চলে কিন্তু প্রান্তিক অর্থনৈতিক দুঃসহ স্তর অতিক্রম করা হয়ে পড়ে কঠিন। কৃষি, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন, সামাজিক বনায়ন বা বৃক্ষরোপণের দিকে নারীকে উৎসাহিত করতে হবে। নারী নিজের পায়ে দাঁড়ানো মানে কেবল নারীর আত্মোন্নয়ন ঘটবে না, দেশও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে।