তরুণীরাও জড়িয়ে পড়ছে মাদকে

বাংলামোটর নিউ ইস্কাটন কাউন্সিলর গলিতে কয়েকটি বাসায় নিরাপদেই চলে মাদক সেবন ও অনৈতিক কাজ। এ ছাড়া বনশ্রী, মিরপুর, ধানমন্ডি, উত্তরা, ফার্মগেট, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ এলাকায়ও এমন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। এসব আস্তানায় বেশিরভাগ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী যাচ্ছেন

প্রকাশ | ২৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ম রিপা খান
রাজধানীতে মাদকের ভয়ংকর নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ভবন, বিউটি পার্লার, স্পা সেন্টার, আবাসিক হোটেলের আড়ালে চলছে মাদকের রমরমা কারবার। আর ওই কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন তরুণ-তরুণীরা। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি অভিযান ও অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে মাদক সেবনের দ্বারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, নৈতিক মূল্যবোধ। মাদকের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে সমাজ যেন আজ অবৈধ, অনৈতিক, অপরাধমূলক কর্মকান্ডের আঁতুড়ঘর। একটি জাতির সামাজিক, মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংসের অন্যতম এই হাতিয়ার মাদকের বিরুদ্ধে যথাসময় সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন না করলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই জাতি অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদকের নেশা এমনই এক নেশা, যে নেশার কাছে সমাজ সংসার সব তুচ্ছ হয়ে যায়। মাদক সেবন করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সর্বনাশা মাদকের ছোবলে বহু সংসার ছারখার হয়ে গেছে। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় মাদকাসক্ত ছেলের হাতে ছবি খাতুন নামে এক নারী খুন হয়েছেন। পরে এ ঘটনায় ছবি খাতুনের ছেলে সবুজ হোসেনকে আটক করেছে পুলিশ। সবুজের বাবার দাবি, তার ছেলে নিয়মিত মাদক সেবন করত। মাদকের টাকার জন্য সবুজ তার মাকে হত্যা করেছেন। শুধু মাদক সেবনই নয়, মাদক কারবারের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছেন তরুণ-তরুণীরা। রাজধানীর অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২০ হাজার পিস ইয়াবা এবং দুই তরুণীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- জহুরা বেগম, মেহেরুন নেছা মিম, মো. জালাল মৃধা ও নাসির উদ্দিন। ডিএনসি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত জহুরা ও মিম নামে দুই তরুণী বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে টেকনাফ থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে কক্সবাজার থেকে বিমানযোগে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে আসেন। এরপর ফ্ল্যাগ সংযুক্ত দামি গাড়ি নিয়ে ওই ইয়াবার চালান অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডিতে সরবরাহ করত। জহুরা ও মিম চিহ্নিত মাদক কারবার। তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তাদের একাধিক স্বামীও রয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর পল্টন থেকে ইয়াবাসহ এক তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কামরুন্নাহার আক্তার ওরফে নাহার ওরফে জহুরা নামে ওই তরুণী ৫ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে কাকরাইল ডায়মন্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের সামনে অবস্থান করেন। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। জানা গেছে, ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে সুন্দরী তরুণীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠায়। আবার অনেকেই ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ইমো ও হোয়াটসআপের মাধ্যমে বন্ধুত্ব তৈরি করে। পরে সময় করে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এক পর্যায়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ওইসব হোটেল বা স্পা সেন্টারে নিয়ে যায় টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে। সেখানে গিয়ে মাদক সেবনসহ নানা অপকর্ম করে। এ সময় গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে অনেকের ছবিও তুলে রাখা হয়। তবে মাঝেমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্পা সেন্টারে অভিযানের নামে আইওয়াশ করা হলেও বিউটি পার্লার, বিভিন্ন আবাসিক ভবন, আবাসিক হোটেলে নিরাপদেই কর্মকান্ড পরিচালনা করে অপরাধী চক্রের সদস্যরা। রাজধানীর গুলশানের ১২৩ নম্বর সড়কের ২১ নম্বর বাড়িতে একটি স্পা সেন্টারে অভিযান চালানো হয়। সেখানে স্পা সেন্টারের আড়ালে দীর্ঘদিন থেকে অনৈতিক কার্যকলাপ চলছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে শুরুতেই তোপের মুখে পড়ে পুলিশ। পরে ডুপেস্নক্স ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ছোট ছোট রুমে অনৈতিক কাজের প্রমাণ পায় পুলিশ। কেয়ারটেকার জানায়, অধিক অর্থের লোভে ফ্ল্যাট মালিকদের যোগসাজশে সেখানে চলে দেহব্যবসা। ওইদিন গুলশান ও বনানীতে তিনটি স্পা সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ২৮ তরুণ-তরুণীকে আটক করা হয়। পুলিশ জানায়, এসব স্পা সেন্টারে চলে মাদক সেবনও। বারবার অভিযান চালানো হলেও আইনি দুর্বলতার কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব অপকর্ম। ডিএমপির গুলশান জোনের এডিসি নাজমুল হাসান ফিরোজ বলেন, ভালো পরিবারের ছেলে যারা নিজেদের বাসায় মাদক সেবন করতে পারছে না, তারা এখানে আসছে। এসব জায়গা তারা বেছে নিয়েছে, প্রচলিত আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে এক সপ্তাহ বা ১৫ দিন বা একমাস পর জামিনে মুক্ত হয়ে অন্যত্র যায় তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর অভিজাত ও জনবহুল এলাকায় আবাসিক ভবনে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে এসব কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। বিশেষ করে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বনশ্রী, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, মিরপুর, বারিধারা, উত্তরা এলাকায় এসব কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। এ ছাড়া কাকরাইল ফুটওভার ব্রিজের আশপাশ এলাকায় আবাসিক ভবনে বিভিন্ন নামে মিডিয়া সেন্টারে আড়ালে এমন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। বাংলামোটর নিউ ইস্কাটন কাউন্সিলর গলিতে কয়েকটি বাসায় নিরাপদেই চলে মাদক সেবন ও অনৈতিক কাজ। এ ছাড়া বনশ্রী, মিরপুর, ধানমন্ডি, উত্তরা, ফার্মগেট, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ এলাকায়ও এমন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। এসব আস্তানায় বেশিরভাগ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী যাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে নিরাপদে মাদক সেবন ও অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে তারা। রাজধানীতে এসব কাজে জড়িত প্রায় শতাধিক চক্র রয়েছে। একটি চক্রে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, ওইসব চক্রের সদস্যরা গ্রম্নপভিক্তিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে একজন টিম লিডার হিসেবে কাজ করেন। এমনকি ছোট ছোট গ্রম্নপে ভাগ হয়ে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে এবং হোস্টেলে নবাগত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করেন। এক পর্যায়ে ওই বন্ধুদেরও এমন অপরাধে নিয়ে আসেন। এ সময় অপরাধ কর্মকান্ডের চিত্রও গোপন ক্যামেরায় ভিডিও করে রাখা হয়। কোনো সময় যদি টিম লিডার বা গ্রম্নপের তথ্যের বাইরে গেলে তাকে গ্রম্নপ থেকে বের করে দেওয়া হয়। এমনকি ওই গ্রম্নপের অপকর্ম যাতে কাউকে না বলে এ জন্য হুমকি দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, যেসব তরুণ-তরুণী স্পাতে গিয়ে মাদক সেবন করেন তাদের মধ্যে কয়েকটি লক্ষণ দেখা যায়। প্রথমত তারা একাকী থাকতে ভালোবাসে। এ ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কম কথা বলা, নিজের পরিচয় গোপন রেখে বন্ধুত্ব করা, সব সময় মিথ্যা কথা বলা, নিজের অভিভাবকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপবাদ দেওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া এসব অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা করতে এবং অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন তারা। কেউ কেউ টিউশনি, কেউ কেউ কোচিংয়ের কথা বলে অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নেহাল করিম বলেছেন, প্রথমত মাদক এখন সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় সবাই গ্রহণ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফলতির কারণে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাদক আসছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও কঠোর হতে হবে। যাতে মাদক সহজলভ্য না হয়। তিনি আরও বলেন, সরকারের মদদপুষ্ট না হলে কেউ কোনো অপরাধ করতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় মাদক কারবার চলছে। কারণ তারা এর ভাগ পায়। রাজনৈতিক প্রভাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো ভূমিকা থাকলে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সন্তানদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে। তাদের সন্তানের পকেট খরচ বেড়ে যাচ্ছে কিনা, বেশি রাতে বাড়ি ফেরে কিনা, নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে নাকি, দেরি করে ঘুম থেকে উঠে নাকি ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি নজর রাখতে হবে। পিতা-মাতাকে সন্তানের বেশি করে সঙ্গ দিতে হবে। সন্তানদের কখনো একাকীত্ব থাকতে দেওয়া যাবে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান বলেন, মাদকের প্রভাব বুঝতে পেরে আমাদের দপ্তরের মহাপরিচালক কয়েকটি অ্যাকশন পস্ন্যান নিয়েছেন। এই পস্ন্যান অনুযায়ী আমাদের অপারেশন, প্রচার-প্রচারণার কাজ চলছে। এ ছাড়া অ্যাকশন পস্ন্যান বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কর্মশালা করা হয়েছে। এ পস্ন্যান বাস্তবায়ন হলে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। প্রতিটি পিতা-মাতার উচিত তাদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনার্থে মাদক থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। তাদের সঠিকভাবে দেখাশোনা করা, তাদের প্রতি অধিক যত্নবান হওয়া। চারদিকে যে সামাজিক অবক্ষয় ও অস্থিরতা এর জন্য মাদকের বিপজ্জনক বিস্তার দায়ী। এখনো যদি সরকারের টনক না নড়ে তবে, এই মাদককে কেন্দ্র করে যুবসমাজ যেমন ধ্বংস হয়ে যাবে, একইভাবে দেশের ভবিষ্যৎও হুমকির মধ্যে পড়বে।