শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে বিয়ে বিচ্ছেদ

ম মো. মিজানুর রহমান
  ২৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

জীবনের সার্থকতা এবং সুখ কোথায়? সুখ যদি আভিজাত্য ও টাকা-পয়সা হয়, তাহলে মানুষ নেতা হতে চায় কেন? আবার সেলিব্রেটি হলে জীবন-সংসারে সার্থক নয় কেন? অনেক সেলিব্রেটির সংসার টেকেনি। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং স্ত্রী মারিনা উইলারে ২৮ বছরের দাম্পত্য জীবন বিচ্ছেদ, বিল ও মেলিন্ত গেটস তাদের বিয়ের ২৭ বছর পর বিচ্ছেদ, আমির খান ও কিরন রাও, হৃতিক রোশন-সুজানের, তাহসান-মিথিলার বিচ্ছেদ। হলিউড থেকে ঢালিউড, শহর থেকে গ্রাম প্রতিদিনই ঘটেছে বিচ্ছেদ। এত এত বিচ্ছেদ!

একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরি, পত্রিকা থেকে নেওয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুটি এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৩০৯টি তালাক কার্যকর হয়, যার মধ্যে স্ত্রী কর্তৃক ১৬৯২টি এবং স্বামী কর্তৃক ৯২৫টি। ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তালাকের সংখ্যা ৩৫৮৯টি এর মধ্যে ২৩৮১টি স্ত্রী কর্তৃক এবং স্বামী কর্তৃক ১২০৮টি, পরিসংখ্যান অনুযায়ী তালাক দেওয়া ৩০ শতাংশ পুরুষ আর নারী ৭০ শতাংশ। কুমিলস্না জেলার ৩০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান এবং সচিবদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১ একবার বিয়ে বিচ্ছেদ নিয়ে বিচার করতে হয় এমন ইউনিয়নের সংখ্যা ৭টি, প্রতি ২ সপ্তাহে অন্তত ১ (বার) বিয়ে বিচ্ছেদ নিয়ে বিচার করতে হয় এমন ইউনিয়নের সংখ্যা ১২টি, প্রতি ৩ (তিন) সপ্তাহে বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে বিচার করে এমন ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ১৮টি। এত এত বিচ্ছেদের কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি। ছোটখাটো ঝুট-ঝামেলা থেকে বড় ধরনের ঝামেলার দিকে ধাবিত হয়। ছোট ছোট মান-অভিমান অভিযোগ ইত্যাদি যত সম্ভব সঙ্গে সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে ফেলা। পারিবারিক কারণে ঘৃণা ক্ষোভ অন্তরে পুষে রাখলে পরে বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমিত্ব না করে পারস্পরিক সহর্মর্মিতা, সহযোগিতা, সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাশীল আচরণ একটা পরিবারের দৃঢ় বন্ধন তৈরি করতে পারে। অনেক স্বামী-স্ত্রীর আছে বিভিন্ন অহেতুক কারণে একে-অপরকে খোটা দেয়, এটা আমার টাকার কেনা। আমার অধিকার। এটা আমার পৈত্রিক সম্পত্তি, তুমি কেন ব্যবহার করবে স্বামী-স্ত্রী আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবীদের সামনে অযাচিত কারণে এক-অপরকে ছোট করা, হেয় করা। এমন ছোট ছোট বিষয়ে বিষিয়ে তুলতে পারে পারিবারিক জীবন। বর্তমান যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চধংং পড়ফব না দেওয়া, স্মার্টফোন ধরতে না দেওয়া।

সর্বশেষ যে কারণটা আজ মারাত্মক ব্যাধি আকারে ধারণ করেছে তা হলো পরকীয়া। পরকীয়ার কারণে শুধু পরিবারের বন্ধন ভাঙছে তা নয় কোথাও কোথাও হত্যা, গুমের মতো অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ধরনের বিনোদনধর্মী অ্যাপস এবং স্মার্টফোনের সাহায্যে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়, খুব সহজে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে শুরুটা হয় দুষ্টামি দিয়ে অল্প অল্প কথায় শুরু হয় ভালো লাগার গল্প। এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর শুরু হয় মন দেওয়া-নেওয়া, সত্যি কথা বলতে কি একটি অবিবাহিত মেয়ের চেয়ে বিবাহিত মেয়েরা তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা বিভিন্ন ধরনের অ্যাপসের অনেক বেশি নক পায়। অনেক পুরুষ বিবাহিত মেয়েদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। একজন মেয়ে সংসারে স্বামীর সঙ্গে অশান্তি, আর্থিক অভাব-অনটন, আত্মীয়স্বজন কেউ না বুঝা/না বলা কষ্ট অপরিচিত কারও সঙ্গে শেয়ার করে হালকা হতে চায়। সংসার নামক দৈনন্দিন কাজের জালে আটকিয়ে রাখতে পছন্দ না করা, স্বামী-স্ত্রী বিবাহের প্রথম-প্রথমের মতো একে-অপরকে ভালো না বাসার অভিযোগ, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়, পরিবারের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় না হওয়া, পাশ্চাত্যের লাইফ স্টাইল অনুসরণ, স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের প্রতি দায়িত্বশীল না হওয়া। যে কোনো কারণে হঠাৎ একে-অপরকে ভালো না লাগা, যৌন তৃপ্তি না পাওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেসহ লাইকি, টিকটক, ইউটিউবার করতে না দেওয়া, পারিবারিক চাপে বিয়েতে বাধ্য করা, স্বামী-স্ত্রীর বয়সের অসামঞ্জস্য, দীর্ঘদিন একে-অপরকে ছেড়ে একা বাস করা, বিয়ের পূর্বে যৌনতায় অভ্যস্ত থাকলে বিয়ের পর যৌন তৃপ্তি না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, আর্থিক সংকট, স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের প্রতি যত্নবান না হওয়া, একে-অপরের প্রতি বিশ্বাস না থাকা, সংসার জীবনে বন্ধুত্বের প্রাধান্য দেওয়া, যে কোনো সংকটে পরিবারের সদস্যদের পাশে না পাওয়া, সিনেমাটিক জীবন অনুসরণ করা, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত মর্যাদাহানির ভয় না থাকা, পারিবারিক জবাবদিহিতা না থাকা, খুব কাছাকাছি আসা যায় এমন উপকরণ সহজলভ্য পাওয়া (যেমন- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার, ভাইবার ইত্যাদি) এবং ধর্মীয় অনুভূতি না থাকাসহ ধর্মীয় নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে চলা।

তাছাড়া সামাজিক জীবনে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয় হওয়া। এভাবে বন্ধুত্বের আড়ালে চলে ভয়ংকর পরকীয়া, পরকীয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রীকে হত্যা, স্ত্রী-স্বামীকে হত্যা, কখনো কখনো সন্তান হত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে দ্বিধা বোধ করে না। একটি বিচ্ছেদের কারণে একাধিক পরিবার ভেঙে পড়ে এবং সামাজিক মর্যাদার হানিকর হয়। সন্তানদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরে এই সন্তানই হয়ে ওঠে মাদকাসক্ত। সত্যি বলতে কি? ডিভোর্স বা বিয়ে বিচ্ছেদ কোনো অপরাধ নয় তবে পরকীয়া একটি অপরাধ, যা সামাজিক ব্যাধিতে আজ পরিণত। এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক বিরোধ যেমন প্রচারনা আছে, তেমনি পরকীয়া ফলাফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারনা করা উচিত।

সুখ মানব মস্তিষ্কের একটি মাত্র স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যার চিন্তা, চেতনায় এবং দৈনন্দিন কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেই নারী হচ্ছে সংসারী যে কিনা তার সংসার এবং সন্তানের জন্য হাসতে হাসতে জীবনও দিয়ে দিতে পারে। স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের জন্য ছোট ছোট উৎসর্গ সংসারকে করে তুলতে পারে স্বর্গের মতো। স্বামীর পেশার প্রতি স্ত্রীর আগ্রহ এবং উৎসাহ সফলতার সঙ্গে সুখ ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। স্বামী তার কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থ তা নিয়ে স্ত্রী কোনোভাবেই খোটা দেওয়া উচিত নয়। কোনো কোনো স্বামীর কিছু অভ্যাস থাকতে পারে- যেমন টিভিতে খেলা দেখা, মুভি দেখা, ইত্যাদি, স্ত্রীরা এসব জিনিস নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর না করে কফি নিয়ে আপনিও একটু সঙ্গ দেন, দেখবেন সময়টা কেমন উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। ভিনেগার দিয়ে মাছি ধরার চেয়ে চিনি দিয়ে মাছি ধরা অনেক সহজ, তেমনি ঘ্যানর ঘ্যানর না করে মিষ্টি কথায় অনেক কিছু পাওয়া যায়। যেসব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ লেগেই থাকে।

আপনারা আগে নির্ধারণ করেন। কী চাচ্ছেন? সমস্যা কোথায়? কেন হচ্ছে? শেষ গন্তব্য কী? বিচ্ছেদ কি আপনার সুখ দেবে? দুজন একসঙ্গে বসেন, একটু ভাবুন, একে-অপরের প্রতি এতদিনের উৎসর্গ, ভালোবাসা, বন্ধন, সহমর্মিতা, সহযোগিতা কল্পনা করুন। আপনি ভাবেন তো আপনার স্ত্রীর সারাদিন পিঁপড়ার মতো ক্লান্তিহীন পরিশ্রম আপনার পরিবারের জন্য, নতুবা সংসারের জঞ্জাল থেকে বের হয়ে কোথাও ঘুরতে যান। রূপ যৌবন আর যৌনতার নাম সংসার নয়। আপনার অস্তিত্বের নাম জীবন সংসার। যেখানে আপনার উত্তরাধিকার হবে এবং সুন্দর একটা পরিবার পাবে। যাদের জন্য আপনি রেখে যেতে চান আপনার সুন্দর এ জীবন কর্মকাল এবং তাদের জন্য কিছু ঐশ্বর্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে