বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজে নিরাপত্তাহীন নারী

ম সালমা বিনতে হক
  ২৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ইদানীং নারীর নিরাপত্তা ও বাংলাদেশ যেন দুটি পরস্পর-বিরোধী শিবিরে অবস্থান করছে। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই রোজই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও নারী অপহরণ, নারীকে বিবস্ত্র করা, তাকে নানাবিধ দৈহিক নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা এতই বেশি যে, তা দেখতে দেখতে সেগুলো যেন সবারই গা-সহা হয়ে গেছে। তাই প্রতিবাদের ভাষাও অত্যন্ত সীমিত- প্রতিরোধ প্রচেষ্টাও দৃশ্যত : অস্তিত্বহীন। আমি সামাজিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথা বলছি।

আজ সর্বাধিক ভয়াবহ রূপ নিয়ে বাংলাদেশের সমাজের নানা স্তরে আবির্ভূত হয়েছে যৌন অপরাধ। নারী দেহ আজ এক শ্রেণির পুরুষদের কাছে সীমাহীন লোভের শিকারে পরিণত হয়েছে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা। এই দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছেন যেমন নারী সংগঠনগুলো, তেমনই তা ছিল সব গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকামী দল ও সংগঠনের অন্যতম প্রধান দাবি। এই দাবি পাকিস্তান আমল থেকেই ক্রমশ জোরদার হতে হতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের নারী সমাজও রাইফেল হাতে নিয়ে পাকিস্তান সেনা ও তাদের এ দেশীয় লেজুড়দের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করেছেন। এসব কিছুর পরিণতিতে নারী সমাজ অতীতের তুলনায় অনেক অধিকারও অর্জন করেছেন। যেমন চাকরির ক্ষেত্রে। এখন নারী হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে, প্রশাসনিক নানা উচ্চপদে, যেমন- সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, পুলিশ সুপার, ব্যাংকগুলোর নানা দায়িত্বশীল পদে তারা নিয়োগ পাচ্ছেন। অবশ্য চাকরিতে নারীদের এখন পর্যন্ত স্বীকৃত পদের সংখ্যা ৩০ ভাগ হলেও প্রশাসনিক ও নানাবিধ টালবাহানায় সেই নিরিখ পর্যন্ত নিয়োগ নারীরা এখনও পাননি। তবু দেশের নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ আদালতে আইনজীবী এবং তাদের সহকারী পদে, বিভিন্ন অফিস-আদালতে নানা স্তরের কেরানির পদে বেশ ভালো সংখ্যক মহিলা কাজ করে চলেছেন। এছাড়া এখন বাজার-বিপণীসমূহে মোটামুটি বেশ সংখ্যক নারী বিক্রেতা হিসেবেও কর্মরত। এইভাবে যে হাজার হাজার কর্মরত মহিলা আমাদের সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেছেন- তার শতকরা ৯৫ ভাগই বা তারও বেশি পায়ে হেঁটে বা রিকশায় বা স্কুটারে বা বাসে চড়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন যাতায়াত করেন। নিজ নিজ অফিসের কাজকর্ম সেরে এদের অনেকেরই ফিরতে সন্ধ্যা বা রাতও হয়ে যায় অনেক সময়। ফলে ফিরতি পথের যাত্রাকালে মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে হয় তাদের। বাসে দেখা যায় চালক, হেলপার এবং এক শ্রেণির পুরুষ যাত্রীর লোলুপ দৃষ্টি, কেউ বা সুযোগ পেলে নারী দেহের স্পর্শকাতর কোনো অঙ্গ স্পর্শ করে বা যাত্রীহীন অবস্থায় পেলে বিবস্ত্র করা ও ধর্ষণ, গণধর্ষণ করার কাহিনী এখন সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় প্রায় নিয়মিতই স্থান পাচ্ছে। খবরগুলোই যেন আতঙ্কের সৃষ্টি করে। আরও ভয়াবহ অনেক খবরের মুখোমুখি সংবাদপত্রের পাঠকদের প্রায়ই হতে হয়। যেমন মাদ্রাসা শিক্ষক তার নাবালক ছাত্রীকে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তার সহপাঠিনীকে, শিক্ষক তার ছাত্রীকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করছেন। এমন কি, কোনো কোনো শিক্ষিকা তার ছাত্রকে বাসায় ভিন্ন কথা বলে ডেকে এনে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হতে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে ছাত্রটিকে শেষ পর্যন্ত তাতে বাধ্য করার কাহিনীও প্রকাশ হতে দেখা যায়। এ ছাড়া অফিস-আদালতে কর্মরত নারী সমাজের কাউকে কাউকে পুরুষ সহকর্মী বা তাদের উচ্চতর কর্মকর্তা দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার কাহিনীও একেবারে কম নয়। এইসব ক্ষেত্রে অবশ্য চাকরির নিরাপত্তা, সমাজের চোখে হেয় হওয়ার আশঙ্কাজনিত কারণে শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ঘটনাই ভুক্তভোগী হন। ফলে অপরাধীদের শাস্তি বা তাদের বিচারও সবকিছুর আড়ালেই থেকে যায়। কাজেই নারী জীবনের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারটি একদিকে যেমন জটিল, অন্যদিকে তেমনই তার জন্যে উপযুক্ত উদ্যোগও এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে