শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরীদের স্বপ্ন ভঙ্গ

ম আয়াতুন নাহার
  ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

এ দেশের কিশোরীরা নানা ধরনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তাদের স্বপ্ন বাস্তবের নাগাল পায় খুব কমই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। এই স্বপ্ন ভঙ্গের প্রধান দিক হচ্ছে বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক সমস্যা। এর ফলে দেশের কন্যাশিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে তলিয়ে যায়। এমনকি স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে গিয়ে মৃতু্য ডেকে আনে। বাল্যবিয়ের কারণে অনেকেই অত্যাচার নির্যাতনে মারা যাওয়া কিংবা আত্মহননের পথও বেছে নেয়। এছাড়া বাল্যবিয়ের ফলে স্বপ্ন ভেঙে যায় অনেক কিশোরীর। স্কুলে যাওয়া এবং নিজেকে অনেক বড় করার প্রত্যয় নিয়ে যখন নিজের স্বপ্নকে সাজাতে শুরু করে একজন কিশোরী- আর তখন যদি তার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় বাল্যবিয়ের কারণে; তবে এটা কতটা উদ্বেগের সে কথা বলাই বাহুল্য।

জাহান একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। দেখতে যেমন সুশ্রী তেমনি গুণে ও অন্যনা। প্রচন্ড মেধাবী। পাশাপাশি গানও গাইতে পারে। পরীক্ষায় সব সময় প্রথম স্থান। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে ও বেশির ভাগ পুরস্কার চলে যায় তার দখলে। মেয়েটি শিক্ষকদেরও নজর কেড়েছে। কেননা, অন্য সব শিক্ষার্থী থেকে সে আলাদা। তার আচার-আচরণ লেখাপড়া সব মিলিয়ে অসাধারণ।

কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে এক অদৃশ্য জীবাণু এসে পৃথিবীর হাসি কেড়ে নিল। দুষ্ট জীবাণুর দাপটে মানুষ দিশেহারা হয়ে গেল। কীভাবে এই কোভিড-১৯ মোকাবিলা করা যায় পৃথিবীর সব বিশেষজ্ঞদের ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আর দেখা গেল, তারই পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একের পর এক ছুটি ঘোষণা হলো। বাংলাদেশেও যখন কোভিড-১৯ এর পাদুর্ভাব বেড়ে গেল- তখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি হয়ে গেল। এই ছুটিতে শুধু জাহান নয়, অসংখ্য ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বিঘ্নিত হয়। বাস্তবতা এমন হলো, সারা পৃথিবী কার্যত থমকে গেল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। আর এরই মধ্যে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। এরপর মানুষ কোভিড প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কার করে। তারপর আস্তে আস্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলো। কিন্তু এরই মধ্যে সেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী কিশোরী মেয়েটির বিবাহ হয়ে গেছে!

শুনেছি, এক বিদেশি পাত্র দেখে বাবা-মা বিবাহের ব্যবস্থা করেন। মেয়েটি আর এগিয়ে যেতে পারল না। বাল্যবিয়ে যে কতটা উদ্বেগের, কতকিছুকে যে ধ্বংস করে দেয় এটাও যেন তার আরেকটি প্রমাণ হিসেবে থেকে গেল। এভাবেই অনেক মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে ঝরে যায়। ঝরে গেল জাহানও। অকালে এরকম অসংখ্যা জাহানের স্বপ্ন ভেঙে পড়ছে। তাদের প্রতিভা বিকশিত হওয়ার পূর্বেই কুঁড়িগুলো দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।

দারিদ্র্যতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, জনসংখ্যার আধিক্য, ইভটিজিং বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ। অনেক অভিভাবক ভাবেন তার পরিবারের মানসম্মানের কথা, ভাবেন তিনি সমাজের অতিদরিদ্র একজন মানুষ। তাই তার কন্যাসন্তান যেন একটা পাহাড়সম বোঝা! এছাড়া মেয়ে একটু একটু বড় হওয়ার পর অভিভাবকের চিন্তার মাত্রাটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। বিয়ে দেওয়ার চিন্তা পেয়ে বসে। ফলে বাল্যবিয়ে কতটা ক্ষতিকর এই বিষয়গুলো নিয়ে সবার সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। পত্রপত্রিকাতে এই আলোচনাও বার বার আসে যে, অর্থনৈতিক-সামাজিক সংকটে কন্যাশিশু ও কিশোরীদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার কারণেও বাল্যবিবাহের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া বাল্য ও জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা ঘটছেই।

দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহমুক্ত রাষ্ট্র গড়তে বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও সামাজিক সংগঠনগুলো সভা-সমাবেশ এবং জনসাধারণ বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের মানুষের মাঝে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে অনেকটা সচেতনতা গড়ে উঠেছে। কিন্তু তারপরেও বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। একের পর এক ঝরে যাচ্ছে অনেক জাহানের স্বপ্ন।

এটাও বিবেচ্য যে, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখে। তদুপরি এ জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটান বা জ্ঞানটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করে- এমন পরিবারের সংখ্যা এখনো আশাপ্রদ নয়। তাই সচেতনতা সৃষ্টি, নারী শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। যেন আর কোনো কিশোরীর স্বপ্ন অকালে ঝরে না যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে