শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতন নয়, পাশে থেকে নারীদের সাহায্য করতে হবে

ম ফারহানা আফসার মৌরী
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

উনিশ শতকের বাংলাদেশ আর বিশ শতকের বাংলাদেশের চিত্রের মধ্যে উন্নয়ন এবং সফলতার অনেক পরিবর্তন থাকলেও নারীরা ঠিক একই রকমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। হোক তা পুরুষদের দ্বারা কিংবা সমাজ দ্বারা। এমনকি অনেক সময় নিজের অজান্তে নিজেকেই নির্যাতিত করে যাচ্ছে, কিছুটা বাধ্য হয়েও এরকম করতে হয় তাদের। আর এর উলেস্নখযোগ্য কারণ হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের টিএফআর (টোটাল ফার্টিলিটি রেট) ছিল ৬ দশমিক ৯। অর্থাৎ ওই সময়ে বাংলাদেশে একজন মা গড়ে ৭টি শিশু জন্ম দিতেন। বর্তমানে তা হয়েছে ২ দশমিক ১। স্বাধীনতার সময় সক্ষম দম্পতির ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। কিন্তু বর্তমানে ৬৩ শতাংশ দম্পতি কন্ট্রাসেপটিভ বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।

এসব পদ্ধতির মধ্যে স্থায়ী এবং অস্থায়ী দুটি ভাগ রয়েছে। অস্থায়ী স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে- জন্মবিরতিকরণ খাবার বড়ি, ইনজেকশন, ডায়াফ্রাম, স্পঞ্জ, কনডম। অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে আইইউডি (ওহঃৎধঁঃবৎরহব উবারপব)। স্থায়ী পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ভ্যাসেকটমি, টিউবেকটমি। এছাড়া রয়েছে কপার টি, কন্ট্রাজেশন, উইথড্রল, আউটারকোর্স ইত্যাদি। এসব পদ্ধতিগুলোর মধ্যে জন্মবিরতিকরণ খাবার বড়ি ব্যবহৃত হয় ২৫%, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন ব্যবহৃত হয় ১১%, কনডম ব্যবহৃত হয় ৭ শতাংশ এবং ভ্যাসেকটমি ব্যবহৃত হয় মাত্র ১ শতাংশ। আর বাকি পদ্ধতিগুলো ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে! যেসব পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয় তার বেশির ভাগই প্রয়োগ করা হয় নারীদের ওপর। আর এসব পদ্ধতির রাসায়নিক প্রভাব খুবই মারাত্মক যা নারীদের তিলে তিলে দুর্বল করে ফেলে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন নিয়ে ঢাকার কিছু পুরুষের সঙ্গে কথা বলার সময় বনানীর এক রিকশাচালক জানান- 'আমার ওয়াফই তো খায়, কি যেন বলে! খাবার বড়ি। আর আমার কোনো পদ্ধতি নাই। আমি কোনো পদ্ধতি নেই নাই। আমার ওয়াইফই ব্যবহার করে।' অথচ স্বামী হিসেবে একবারের জন্যও তার মনে হয়নি যে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে দেখি তার এটাতে সমস্যা হয় কিনা? সেদিন যাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল তাদের বেশির ভাগেরই ভাষ্যমতে জন্মনিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব নারীদেরই! সবেমাত্র কপার টি ব্যবহার করা এক মহিলা বলেন- 'এটা পরার সময় কষ্ট হয়। পরার পর প্রতি পিরিয়ডের সময় পেটে ব্যথা হয়। খুব বেশিই ব্যথা হয়। সেটা কমাতে পেইনকিলার খেতে হয়। এমনকি পিরিয়ড চলাকালে বিস্নডিংটাও অনেক বেশি হয়।' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই মহিলা জানান স্বামীর কনডম ব্যবহারের অনিচ্ছার কারণেই তাকে কপার টি পরতে হচ্ছে। কপার টি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো নারীদের সহ্য করতে হয়: এই পদ্ধতিতে চামড়ার নিচে বসিয়ে দেওয়া হয় জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুল। এটি ব্যবহারে মাসিক অনিয়মিত অথবা উল্টো আবার রক্তস্রাব বেশি হতে পারে। মাথাব্যথা হতে পারে। ওজন বেড়ে যেতে পারে। আর এই সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো শুধু কপার টি-এর ক্ষেত্রেই হচ্ছে না, প্রত্যেকটা পদ্ধতিতেই নারীদের এসব কষ্ট সহ্য করতে হয়। কিন্তু লজ্জার কারণে কাউকে কিছু বলতে না পেরে নিজেই নিজেকে নির্যাতন করে যাচ্ছে।

কনডম ব্যবহারের কারণে পুরুষরা আসল সুখ পায় না তাই এটাতে কোনো প্রকারের রাসায়নিক প্রভাব না থাকা সত্ত্বেও তারা এটি ব্যবহার করে না। তারা বাধ্য হয়ে নারীকেই প্রতি মাসে খাবার বড়ি খেতে হচ্ছে। আর এসব খাবার বড়িতে এত বেশি কেমিক্যাল জিনিসপত্র থাকে যেটা নারীদের হরমোনে প্রভাব ফেলে। মাসিকের পরিমাণ কমে যায়। যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যায়। আমরা সবাই জানি যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রতিটি মেয়ের জীবনে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এই অধ্যায় একটি মেয়েকে পরিপূর্ণ করে তোলে। পিরিয়ড একটি মেয়ের সুস্থতার পরিমাপক। এর ফলে মেয়েদের শরীরে হরমোনাল যেই প্রভাব পড়ে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়াগুলো একটা নির্দিষ্ট নিয়মে চলতে থাকে। একটু সামান্য বাধাগ্রস্ত হলে বিভিন্ন সমস্যা সহ্য করতে হয় মেয়েদের।

উলিস্নখিত পদ্ধতিগুলোর সবকটিতেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে যেগুলো নারীদের শরীরে হরমোনাল প্রভাব ফেলছে। মেয়েরা একটা নির্দিষ্ট সময়ে এমনিতেই কনসিভ করতে পারে না, তারপরও যে কোনো টাইমেই সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা রাখা পুরুষ সম্প্রদায় তাদের সাময়িক সুখের কথা চিন্তা করে নারীদের এভাবে নির্যাতন করে যাচ্ছেন। তারা অনেকেই জিনিসটা ভাবছেনও না যে, তার সঙ্গিনীকে এক প্রকার অত্যাচার করা হচ্ছে, কিন্তু আসলে এটা একটা নির্যাতন! সরকারি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে যেসব পদ্ধতির ব্যাপারে দম্পতিদের উৎসাহ করা হয় তার মাত্র দুটি পদ্ধতি ছাড়া বাকি সবই নারীদের জন্য। আমরা নিজেরাই একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীকে উপদেশ দিচ্ছি, 'কি আর করবি! উনি পদ্ধতি না নিলে তুই-ই নে..'। যেটা করা ঠিক নয়। আমরা এগিয়ে না এলে এই ছোট ছোট ঘটনাগুলো চাপা পড়ে থাকবে আর কালে কালে নির্যাতিত হবে অসংখ্য নারী। এজন্য আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যেমন- পুরুষদের বেশি বেশি উৎসাহিত করতে হবে। অনেকেরই ভাষ্যমতে কনডমের দাম খাবার বড়ির তুলনায় বেশি বলে কনডম ব্যবহার করছে না। এ ক্ষেত্রে দামের দিকেও খেয়াল রাখা উচিত। পুরুষদের এটা বোঝাতে হবে যে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে যেমন নারী-পুরুষ উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনই জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও উভয়কেই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই তো আধুনিক বাংলাদেশ আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। আর নারীরা তাদের প্রাপ্য ফিরে পাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে