বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিপস্নব ঘটিয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা

নতুনধারা
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

ম মুশফিকা মলি

বৈশ্বিক মহামারিতে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলেই যার প্রমাণ মেলে। বাংলাদেশে অফলাইন কিংবা অনলাইন, দুই শাখাতেই বেড়েছে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা। বিশেষ করে অনলাইন ব্যবহার করে অনেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন। করোনাকালে চারদিকে যখন লকডাউন চলছিল, অনেকে চাকরি হারিয়ে দিশেহারা, তখন ঘরে বসে পরিবারের নারী সদস্য হয়ে যান উদ্যোক্তা। আর করোনাকালে লেখাপড়া, ব্যবসা-চাকরি প্রায় সব ক্ষেত্রই হয়ে উঠেছিল অনলাইন নির্ভর। ফলে ঘরে ঘরে তৈরি হয়েছে নারী উদ্যোক্তা। সব মিলিয়ে এখন একটা কম্পিউটার বা মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই করা যাচ্ছে ব্যবসা। এতে করে ই-কমার্সের ঘটেছে ব্যাপক প্রসার। যে কারণে আইটি ক্ষেত্রেও বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। মাহবুবা আক্তার নামে আরেক উদ্যোক্তা জানান, আগে কেবল ফেসবুক খুলে পোস্ট দেওয়া, লাইক দেওয়া কিংবা মন্তব্য লেখায় মধ্যে ছিল আমার আইটি সেক্টরের জ্ঞান। কিন্তু এখন অনলাইনে ব্যবসা করতে গিয়ে কত কিছু যে শিখেছি, নিজেই বলতে পারব না। কাজের প্রয়োজনে, রাত জেগে প্রশিক্ষণ নিয়েছি আইটির অনেক বিষয়ে।

ঘরে বসে আয় করা যায় বলে নারীদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য অনলাইন বিজনেস। করোনাকালে অনেক নারী ই-কমার্সে যুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করছেন তারা। ২০১৭ সালে উমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)-এর যাত্রা শুরু। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১১ লাখ ২১ হাজার। এদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তা ৪ লাখ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এক দশকের ব্যবধানে নারী উদ্যোক্তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি গবেষণার বিভিন্ন তথ্য মতে, দেশে প্রায় তিন দশক আগে তথ্যপ্রযুক্তির যাত্রা শুরু হলেও আইটি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে শীর্ষ পর্যায়ে নারীর অবস্থান এক শতাংশের নিচে। তবে করোনার কারণে এ ক্ষেত্রে ঘটেছে বিপস্নব। সরকারি হিসাবে, তথ্যপ্রযুক্তিতে কর্মক্ষেত্রে ১২ শতাংশ নারী কাজ করছেন। তার মধ্যে অধিকাংশই প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের কাজ করেন। 'বিজনেস প্রসেস আউটসোর্স-বিপিও' তথ্যমতে, শিল্পে দেশে ৪০ শতাংশ নারী কাজ করছেন। বিশ্বব্যাপী বিপিও শিল্পের ৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বাজারে বাংলাদেশের দখলে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

\হদেশের নারীরা তাদের মেধা প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতা এবং তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতার মাধ্যমে ই-কমার্সে বিপস্নব সৃষ্টি করেছেন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে তারা ঘরে বসে ক্ষুদ্র পরিসরে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। সরকারের ডিজিটাল সেবার বিপস্নবের কারণে অনলাইনে নারীরা এখন ব্যবসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ এবং সরকারের আর্থিক ও নীতিগত সহায়তার সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত হয়ে গড়ে তুলছেন শিল্পকারখানা। কর্মসংস্থান তৈরিতে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে ব্যবসা পরিচালনার আনুষঙ্গিক কার্যক্রম আগের তুলনায় অনেক সহজ করা হয়েছে। নারীরা এক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাও পাচ্ছেন। সেই সুযোগে তারা হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। বর্তমানে দেশে প্রতি বছর যতজন উদ্যোক্তা হচ্ছেন- তার মধ্যে ৩২ শতাংশই নারী। এছাড়া করোনা মহামারির মধ্যে অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আছেন।

বর্তমানে নারী উদ্যোক্তারা চাইলে জামানতবিহীন ঋণ নিতে পারছেন। যেহেতু নারীদের পক্ষে জামানত দেওয়া কঠিন কাজ, সেই বিবেচনায় সরকার এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে নারী উদ্যোক্তাদের তুলনামূলক কম সুদে জামানতবিহীন ঋণ দিচ্ছে।

এসএমই ফাউন্ডেশন গত অর্থবছরে মোট ২০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে- যার মধ্যে ৩০ শতাংশ বা ৬০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের। এখান থেকে একজন উদ্যোক্তা ১ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পেরেছেন। এর মধ্যে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য কোনো জামানত দিতে হয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংক সার্বিকভাবে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণদানের ক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়েছে। প্রচলিত ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও নারী উদ্যোক্তারা ৫ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের 'স্মল এন্টারপ্রাইজ খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম'-এর আওতায় স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের মধ্যে এ খাতে প্রদত্ত ঋণের অন্তত ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা অত্যন্ত সৃজনশীল। তারা যে কোনো কঠিন কাজও দেখে দেখে শিখে নিতে পারেন। তবে, তাদের অর্থায়ন প্রাপ্তি আরও সহজ হলে তারা আরও এগিয়ে যাবেন। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যে সব নীতি সহায়তা দিয়েছেন, সে সম্পর্কে নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই অবহিত নন। এ বিষয়ে নারী উদ্যোক্তাদের অবহিত করতে আরও উদ্যোগী হওয়ার দরকার।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্যমতে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, গত এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঈদসহ যে কোনো উৎসবে এ লেনদেন বাড়ে।

নারী উদ্যোক্তাদের কেউ পোশাক, কেউ গয়না, কেউ হাতে তৈরি নানা জিনিস, কেউ তৈরি খাবারসহ নানা পণ্য বিক্রি করছেন। অনেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজ করছেন। কেউ শৌখিন পণ্য নিয়ে ব্যবসায় নেমেছেন। এ নারীরা শিক্ষিত। সংসারের চাপসহ নানা সমস্যায় অনেকের পক্ষে চাকরি করা সম্ভব হয়নি। অনেকে নিজে কিছু করবেন বলে বদ্ধপরিকর। যার ফলে সংসার সামলানোর পাশাপাশি স্বাধীন এ ব্যবসায় আগ্রহ বাড়ছে নারীদের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে