বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর কাজের মর্যাদা

ম জিশান আরা মিতু
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

প্রাচীন যুগে যেখানে নারীর হাতে বোনা বীজ দিয়ে চাষাবাদের প্রচলন হয়েছে, মানুষ পশুপালন সভ্যতা থেকে কৃষি সভ্যতার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, সেখানে কৃষিক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কতটুকু, সেটা সহজেই অনুমেয়। গ্রাম-বাংলার নারীদের কাছে অনেক কাজের মধ্যে কৃষিই গুরুত্বপূর্ণ। বীজ সংরক্ষণ ও বপন থেকে শুরু করে চারা রোপণ, সেচ, ফসল উত্তোলন এমনকি বিপণনেও নারীরা এককভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে।

\হবাংলাদেশের মোট এক কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে ৭৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৯২ লাখ নারীই কৃষিকাজ, মৎস্যচাষ ও সামাজিক বনায়নের সঙ্গে জড়িত। বিবিএস'র তথ্য পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে যে, সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় (কৃষি-বন-মৎস্য খাত) নারীর অংশগ্রহণ অনেকাংশে বেড়ে গেছে। তবে কষ্টের বিষয় হলো, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কৃষি খাতে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর দেয়া শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। যেসব নারী দিনমজুর হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করে, তারা প্রতিনিয়তই মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়, সেই সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে তাদের কাজে নিয়োজিত রাখা এবং অন্যান্য মানসিক নিপীড়ন। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, নারী-পুরুষের সমকাজে সমান মজুরি প্রদানের কথা থাকলেও চারা রোপণ ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে পুরুষদের দৈনিক মজুরির চেয়ে নারীদের মজুরি অনেক কম। আপাতদৃষ্টিতে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পেছনে নারীর ক্ষমতায়নের কথা মনে হলেও এর মূল নেপথ্যে রয়েছে স্বল্প মজুরি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করানোর সুবিধা।

এদিক দিয়ে যারা নিজ জমিতে শ্রম দেয়, তাদের চাষাবাদের কাজে নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টি বর্তমান সভ্য সমাজেও নারীদের প্রাত্যহিক কাজের অংশ হিসেবেই ধরা হয়, মজুরি প্রদানের বিষয়টি সেখানে নিতান্তই হাস্যকর। বাংলাদেশ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে, নারীর সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রণীত ২২টি লক্ষ্যের মধ্যে নবম লক্ষ্যটি হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কৃষি খাতে নারী শ্রমিকের কোনো বৈধ পরিচিতি নেই। পাঠ্যপুস্তকের কবিতায় কিষান-কিষানি শব্দের ব্যবহার থাকলেও, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে 'কিষানি' শব্দটির কোনো ব্যবহার নেই। তবে কি ধরে নেয়া যায়, নারীর কাজের মর্যাদা পূর্বের তুলনায় কমে গেছে নাকি সাহিত্যিকরাই কেবল তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে পারে, তাদের আর্থ-সামাজিক নিপীড়নের কথা লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে পারে? সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যাদের, তাদের কি কিছু করার নেই, নারীর কাজের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে?

কৃষি খাতের ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭ ধরনের কাজেই গ্রামীণ নারীরা অংশগ্রহণ করে। অথচ কৃষি তথ্য সার্ভিসের 'কৃষিতে নারী' শীর্ষক প্রতিবেদনে কৃষি জমির মালিকানায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ১৯ শতাংশ। সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদন থেকেও উঠে এসেছে যে, নারীরা পুরুষের তুলনায় ৩ গুণ বেশি কাজ করে। অন্যদিকে, যেসব নারী অবৈতনিকভাবে কৃষি খাতে ও পারিবারিক শ্রমে জড়িত, তাদের সিংহভাগই মজুরি নিয়ে অন্যের জমিতে কাজ করতে আগ্রহী নয়। যার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো- পারিবারিক অসম্মতি, কাজের অবমূল্যায়ন ও মজুরি বৈষম্য। পারিবারিক অসম্মতির বিষয়টি অনেকটা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা মুখে না বললেও তারা বুঝিয়ে দেয় যে, নারীদের সন্তান লালন-পালন ও ঘরের কাজ সামলে নিয়েই বাহিরের কাজ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে একজন নারীর পক্ষে সারাদিন বাড়ির বাইরে থেকে অন্যের জমিতে শ্রম দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলশ্রম্নতিতে নারীরা না পায় গৃহস্থালির কাজের মর্যাদা না পায় কৃষি খাতে প্রদেয় শ্রমিকের কাজের মর্যাদা। নারীদের শ্রম মূলত গ্রামীণ কৃষি-অর্থনীতিতে পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, বরং ফসল উৎপাদনে সামগ্রিক ব্যয় হ্রাসের উৎস হিসেবে তা পরিগণিত হয়। কাজেই কৃষি তথা দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নারীদের কাজের মূল্যায়ন তাদের শুধু নারী হিসেবে বিবেচনা করে নয়, মূল্যায়ন করা উচিত তাদের সামগ্রিক দক্ষতাকে বিবেচনায় এনে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে