বাস্তবতায় মোড়ানো মেয়েদের হলজীবন

বাস্তব একটা জীবনের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ করে দেয় এই হলজীবন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আবাসিক হলে বসবাসকারী ছাত্রীদের অধিকাংশই পরিবার-পরিজন ছেড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে থাকেন। কিন্তু হলে এসে তারা খুঁজে পেয়ে যান বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সহযোগিতা আর সহমমির্তা। অপরিচিত এক একটি মুখ সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠে কতদিনের চেনা জানায়। হলজীবনের হাসি-কান্নামাখা জীবনের গল্প। আড্ডা-গানে মেতে থাকার আনন্দঘন মুহূতর্, সিনিয়র-জুনিয়র মিলে একসঙ্গে রাত জেগে আড্ডা, ছাদে বৃষ্টিতে ভেজা, রাতের জ্যোৎস্না উপভোগ, বন্ধুরা মিলে হঠাৎ ঘুরতে যাওয়া। ক্যান্টিনে বসে বিকালের নাশতা। বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ করা। আবার বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিজ জীবনের লক্ষ্য অজের্নর পরিকল্পনা। আর এসব মিলিয়েই আবাসিক হলজীবনে প্রতিনিয়ত নানা অভিজ্ঞতা আর মজার মজার স্মৃতি জন্ম দেয়। সেই সব স্মৃতি আর হলজীবনের গল্প নিয়ে লিখেছেন রুমান হাফিজ

প্রকাশ | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
নিজেকে বড় মনে হচ্ছে ফাইজুন নাহার সিফাত বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাসিির্টতে উঠে আবিষ্কার করলাম, আমি হুট করে বড় হয়ে গিয়েছি! বিশেষ করে হলের জীবন শুরু হওয়াটা। নিজের কাজ নিজেকেই করতে পারার ভিত্তি এখান থেকেই। আমার মতো ঘরকুনো মেয়ে হলে এসে কিছুটা হলকুনো হবে এটাই স্বাভাবিক। তবুও নতুন করে বন্ধুত্ব হচ্ছে, মিশতে শিখছি সবার সঙ্গে। একসঙ্গে সবাই মিলে আড্ডা দেয়া কিংবা সন্ধ্যাবেলা চা খেতে যাওয়া আমার নতুন রুটিন। রুমের দুই বেডমেটের জন্মদিন একইদিনে, সেটা নিয়ে প্ল্যান করাটা যে এত মজার আগে কখনো জানতাম না। আর ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করার কারণে সহজেই ডিপাটের্মন্টে সাহিত্যপ্রেমী কিছু বন্ধু খুঁজে পেয়েছি। এসব ছোট ছোট বিষয়ই আমার কাছে অনেক মূল্যবান। তবে এত কিছুর পরও খারাপ লাগারা থাকবেই। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মিল পাই না অনেক সময়। বাড়ির পরিবেশ মিস করি। সকালবেলা ঘুম ঘুম চোখে পুকুর পাড়ে বসে সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে দিনের শুরু, বিকালের বাড়ির উঠোনে কানামাছি, গল্প করা, সন্ধ্যায় চুপিচুপি আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহাতে যাওয়া, ফের ঘরে এসে মায়ের স্বভাবসুলভ স্নেহময়ী বকা সব কিছুই ভীষণ মিস করি। মন খারাপ হয়। তবু এই যে সবার সঙ্গে মানিয়ে-গুছিয়ে থাকা, এ-ই বা মন্দ কী! নিজেকে একা লাগেনি কখনো মেহেজাবিন নেছা শেখ হাসিনা হল, গণিত বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভাসিির্ট লাইফে হলে না থাকলে ভাসিির্ট লাইফটা ঠিক জমে ওঠে না। পবিপ্রবির শেখ হাসিনা হলের ১০৩ নাম্বার রুমের অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। আমি গণিতে পড়লেও আমার প্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্য। ভাগ্য করে যে রুমমেট পেয়েছি সে বাংলার সেম ব্যাচ। দুজন মিলে পড়ালেখার পাশাপাশি সমান তালে আড্ডা না দিতে পারলে সবকিছু উলাপাল্টা মনে হয়। হ্যঁা। হৈ-হুল্লোড়, রাত জেগে আড্ডা আর বষার্র সকালে বেলকনিতে আমার প্রিয় কাঠগোলাপের সঙ্গে কত গল্প কত স্মৃতিই না আমার হলজীবনে। আর শীতের সকালে রুমমেটের হাতের তৈরি এককাপ গরম কফি জাস্ট ওসাম! নিজকে কখনো একা ভাবার সুযোগই পাই না। বাবা, মা বাড়িঘরের দূরত্ব যেন আমাকে ভুলিয়েই দিয়েছে। সিক্রেট হলো সে আমাকে প্রতিদিন কফি খাওয়ায় তার একমাত্র কারণ সকাল সকাল আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে আমাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে যে কুয়াশা মোড়ানো ঘাসের ওপর শিউলী ফুলের বিছিয়ে থাকা চাদর থাকে সেটা কুড়াতে যাওয়া। আমার অবশ্য মন্দ লাগে না। শুধু যখন ভাবী ফাইনাল ইয়ার চলছে। বিদায়ের ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং। কেমন যেন উদাস লাগে। এই সময়টা সারাজীবন থাকলেই যেন ভালো হতো। জীবনে কিছুটা অসম্পূণর্ রয়ে যেত শারমিন জাহান শশী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হল, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভাগ্যক্রমে চবির খালেদা জিয়া হলে ডাবলিংয়ে একটা সিট পেলাম। হলে থাকলে যথেষ্ট উপভোগ্য ও স্বাধীন জীবন পার করা যায়। আমার রুমে তামান্না আপু, পুনম, পল্লী, তাসপিয়া আর ইষ্টি। অনেক ভালো রুমমেট পেয়েছি। সারাদিন হাসিখুশি থাকে সবাই। একটু মন খারাপ থাকলে সবাই ভালো করার চেষ্টা করে। কোনো কিছুতে বঁাধা দেয়ার কেউ নেই। হলের মুখরিত পরিবেশ। চারদিকে ফুলগাছ, ম-ম গন্ধ, ঠাÐা, মনোরম ও সুন্দর পরিবেশ। ১০-১২টা রুম মিলে একটা বøক। মাসে মাসে বøক মিটিং ছাড়াও বøক পিকনিক হয়। সবাই সাজগোজ করে ছবি তুলতে উন্মত্ত হয়। সে কি ভালো লাগা! এক একটা যেন শাড়ি পরা পরী! লালপরী, নীলপরী, সাদাপরীর মতোই দেখতে লাগে। অনেক আনন্দ হয় সেদিনটায়। আমার মনে হয় হল লাইফ যারা পায় না, তাদের জীবন কিছুটা হলেও অসম্পূণর্। অনেক অনেক বেশি ভালো লাগার একটা স্থান হলো হল। আবার কতগুলো নিয়ম পালন করা লাগে। আমার ওগুলো ভালো লাগে না। এটা করো না ওটা করো না, কেমন যেন রুলসগুলো! তবে হলে থাকার আনন্দটাই সব কিছুকে ছাপিয়ে দেয়। একসমুদ্র মন খারাপ নিমিষেই ভুলে যাই রোকেয়া আশা ফজিলাতুন্নেসা হল, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরে ভতির্র পর থাকার জায়গা হলো গণরুমে! এত্তগুলো মেয়ে। অবশ্য গণরুমে বেশিদিন থাকা হয়নি। গুনে গুনে দশদিন গণরুমে থাকার পরেই রুম দিয়ে দেয়া হয় আমাদের। রুমে উঠলাম ছয়জন। আমি আর গায়ত্রী আবার বেড শেয়ার করলাম। জারিন আর শ্রাবণী আরেকটা বেডে; সিংগেল বেডে থাকতো সোনিয়া আর সেঁজুতি। ছয়জন মিলে তখন নতুন একটা পরিবার। আমি আবার শুরু থেকেই বিতকর্ সংগঠনের সঙ্গে জয়েন করায় প্রায়ই আড্ডা দিয়ে ফিরতে দেরি হতো। তারপর এসেই শুরু হতো সারাদিনের গল্পের ঝুড়ি। ছয়জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকবক আমিই করতাম! সাতমাস পরেই আমি আবার রুম পাল্টাই। আমার ডিপাটের্মন্টের সিনিয়র রাশা আপুর সঙ্গে উঠি। হলে থাকা ডিপাটের্মন্টের বান্ধবী দোলার কাছে প্রতিবার পড়াশোনার চিন্তা করে গেলেও শেষ পযর্ন্ত সেই উল্টাপাল্টা বকবকানি দিয়েই মাঝরাত পার করে ফেলি! আমার হলজীবন কাটছে অসম্ভব কিছু ভালো মানুষের সঙ্গে, যাদের জন্য এক সমুদ্র মন খারাপ ভুলে থাকা যায় সবসময়।আমার জন্মদিনে প্রথম পা রাখা আমার প্রিয় হলটায়। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বেশি শিউলী ফোটা হল।