প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার সফল উদ্যোগ

প্রকাশ | ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মো. বাহারুল ইসলাম মোল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপজেলা নিবার্হী কমর্কতার্ জান্নাতুল ফেরদৌসের উদ্যোগের ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবহেলিত ঋষিপাড়ার নারীদের মুখে এখন হাসির ঝিলিক
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার তিতাস নদীর তীরে অবস্থিত অবহেলিত ঋষিপাড়ার নারীদের মুখে এখন হঁাসির ঝিলিক। সদর উপজেলা নিবার্হী কমর্কতার্ জান্নাতুল ফেরদৌস তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কমর্দক্ষ করায় তারা এখন বাড়িতে বসেই রোজগার করতে পারছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের সীতানগর গ্রামের ঋষিপাড়া একটি পিছিয়ে পড়া জনপদ। তিতাস নদীর তীরে অবস্থিত এই গ্রামের পুরুষরা শহরের বিভিন্ন স্থানে মুচির কাজ (জুতা সেলাই, জুতা পালিশ) এবং শহরের বিভিন্ন বাজারে কুলির (শ্রমিক) কাজ করে। গ্রামের মহিলাদের কেউ কেউ শহরের বিভিন্ন বাসায় গৃহকমীর্র (ঝি) কাজ করলেও অধিকাংশ মহিলা বেকার। বাড়িতে বসেই তাদের অলস সময় কাটতো। ফলে তাদের সংসারে সব সময় লেগে থাকতো অভাব-অনটন। অভাব-অনটনের কারণে ঋষিপাড়ার মেয়েরা লেখাপড়া করত না। বিষয়টি জানতে পেরে ঋষিপাড়ার নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন সদর উপজেলা নিবার্হী অফিসার জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি তাদের উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিলে গ্রামের নারীরা এত দূরে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ সম্ভব নয় বলে তাকে জানিয়ে দেন। পরে উপজেলা নিবার্হী অফিসার জান্নাতুল ফেরদৌস উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের মাধ্যমে ঋষিপাড়ায় একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিমার্ণ করেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিমাের্ণর পর তিনি স্থানীয় সংরক্ষিত ইউপি সদস্যা আনোয়ারা বেগমের মাধ্যমে ঋষিপাড়ার ২৭৫টি পরিবারের ২৪০ জন নারীকে প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করেন। গত ২০১৮ সালের ১ জুলাই ১২০ জন নারীকে নিয়ে প্রথম দফায় ৩ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তাদের পাটজাত দ্রব্য তৈরি, মোমবাতি তৈরি, নকশিকঁাথা সেলাই, টেইলারিং (পুরুষ ও মহিলাদের কাপড় তৈরি) এবং পঁুথি দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রথম দফার প্রশিক্ষণ শেষে গত ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর বাকি ১২০ জনকে নিয়ে দ্বিতীয় দফার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। জামালপুর জেলা থেকে দুজন প্রশিক্ষক এনে তাদের দুই দফায় ৬ মাস প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বতর্মানে দুই গ্রæপের নারীরা (মহিলা ও মেয়ে) প্রশিক্ষণ শেষ করে কাজ করা (উৎপাদন) শুরু করেছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জেল রোডে অবস্থিত নারী উন্নয়ন ফোরামের শো-রুম “অপরাজিতা” নামক দোকানে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়াও শহরের বিভিন্ন মাকেের্টর কাপড়ের দোকানে চাহিদা মতো সরবরাহ করা হচ্ছে। সরজমিনে সীতানগরের ঋষিপাড়ার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ঋষি সম্প্রদায়ের নারীরা বিভিন্ন ধরনের সেলাইয়ের কাজ ও মোমবাতি তৈরির কাজে ব্যস্ত। ১১টি সেলাই মেশিনে তারা বিভিন্ন ধরনের কাপড়-চোপড়সহ ও বিভিন্ন ধরনের পাটের ব্যাগ তৈরি করছে। নারীদের কেউ কেউ তৈরি করছে মোমবাতি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঋষিপাড়ার শরৎ ঋষির মেয়ে সুমিত্রা ঋষি-(১৫) জানায়, তার বাবা শহরের আনন্দ বাজারে শ্রমিকের (কুলি) কাজ করে। তারা ৪ বোন, ১ ভাই। বাবার রোজগারে ঠিক মতো তাদের সংসার চলত না। সে ষষ্ঠ শ্রেণি পযর্ন্ত পড়াশোনা করেছে। অভাবের কারণে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। সুমিত্রা জানায়, প্রথমধাপে সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। বতর্মানে মহিলাদের থ্রি-পিছ, সেলোয়ার, কামিজ ও ছোট বাচ্চাদের কাপড় তৈরি করে প্রতিদিন ভালো টাকা রোজগার করছে। তার রোজগারের কারণে তাদের পরিবারে এখন সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। এ ব্যাপারে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত সদস্যা (৭, ৮ এবং ৯নং ওয়াডর্) আনোয়ারা বেগম বলেন, এটি তার নিবার্চনী এলাকা। তিনি বলেন, তিনি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির তদারকি করেন। আনোয়ারা বেগম বলেন, সদর উপজেলা নিবার্হী কমর্কতার্ জান্নাতুল ফেরদৌসের উদ্যোগের কারণে সীতানগর এলাকার ঋষিপাড়ার মহিলারা এখন স্বাবলম্বী হয়েছে। তাদের মুখে এখন হঁাসি ফুটেছে। এ ব্যাপারে সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট তাসলিমা সুলতানা খানম নিশাত বলেন, প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে সুবিধাবঞ্চিত ঋষিপাড়ার মহিলাদের জন্য এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি নিমার্ণ করা হয়েছে। এ পযর্ন্ত এখানে ২৪০ জন নারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়েছে। তিনি বলেন, উপজেলা নিবার্হী কমর্কতার্ জান্নাতুল ফেরদৌস তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এ জন্য তিনি উপজেলা নিবার্হী কমর্কতাের্ক ধন্যবাদ জানান। অ্যাডভোকেট নিশাত বলেন, তাদের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ইউএনসিডিএফের সদস্যরা পরিদশর্ন করেছে এবং ৫ লাখ টাকা আথির্ক সহায়তা করেছেন। তিনি বলেন, উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের উদ্যোগে মহিলাদের পণ্য তৈরির কঁাচামাল সরবরাহ করা হয় এবং তাদের তৈরি পণ্য নারী উন্নয়ন ফোরামের শোরুম ‘অপরাজিতা’ নামক দোকানে বিক্রি করা হয় ও শহরের বিভিন্ন মাকেের্টর কাপড়ের দোকানে সরবরাহ করা হয়। এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নিবার্হী কমর্কতার্ জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, সীতানগর গ্রামের ঋষিপাড়াটি অবহেলিত ছিল। এই পাড়ার পুরুষরা মুচির কাজ ও বিভিন্ন বাজারের কুলির (শ্রমিক) কাজ করত। মহিলারা ছিল অবহেলিত। পরিবারে মহিলাদের কোনো গুরুত্ব ছিল না। বিষয়টি জানার পর তিনি তাদের অথৈর্নতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এখানকার ২৪০ জন নারীকে তিনি দুইধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাদের জন্য অথের্র ব্যবস্থা করেন। তারা বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প, নকশিকঁাথা সেলাই, মোমবাতি তৈরি ও টেইলারিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন নিজেরা কাজ করতে পারছে। অথৈর্নতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় পরিবারে নারীদের গুরুত্ব বেড়েছে। তারা এখন সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, অবহেলিত নারীদের জন্য কিছু করতে পেরে তিনিও তৃপ্ত।