নারীজীবনের ইতিবৃত্ত

প্রকাশ | ২১ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মনিরা মিতা
দুঃখ শব্দটা চারদিকে গুঞ্জন তুলে কঁাপতে থাকে যার জীবনের পরতে পরতে তার নাম নারী। জীবনের প্রতিটি পাতা যেন দুঃখের সঙ্গে ফ্রেমে বঁাধা। জন্মের আগেই বাবা বলে মেয়ে হলে ঘরে জায়গা নেই। পরিবার বলে মেয়ে হলে টাকার ব্যাগ বানাও যৌতুক দিতে হবে। জন্মই যেন আজন্ম পাপ। ছেলেসন্তান হলে ঘরে মিষ্টির ধুম পড়ে যায় আর কন্যাশিশুটির বেলায় কোলে নিতেও বাধে। আর যদি গায়ের রং কালো হয় তাহলে অপমানের ষোলকলা পূণর্ হলো। উঠতে-বসতে কৃষ্ণকলিকে শুনতে হবে খোটা। গভর্ধারিণী মা পযর্ন্ত মনে করিয়ে দেয় সমাজের চোখে তুই কালো। কন্যাটি সমাজের নিষ্পেনে নিযার্তনে বড় হয়। ধনী পরিবারে জন্মালে নিযার্তন একটু কম আর গরিব পরিবারে জন্মালে বাপের বোঝা। ১২ বছর পার হলেই শুরু হয় বিয়ের নামে সে বোঝা হস্তান্তরের চেষ্টা। বয়সে দ্বিগুণ কোনো দোজবরের সঙ্গে কম যৌতুকে বিয়ে দিলেও বাপ তার তৃপ্তির হাসি হেসে বলে অল্পতেই বিদায় করতে পারছি! স্বামীর ঘরে এসে মেয়েরা ভাবে নতুন জীবন পেলাম। ঘড়-বর-সংসার, সব তার স্বপ্নের মতো সাজাবে কিন্তু কদিন পার হতে না হতেই সে বোঝে এসব কিছুই তার না। সে কেবল বাড়ির একজন বিনাবেতনের ‘ঝি’। শাশুড়ির নিযার্তন আর স্বামীর অবহেলা যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। কখনো হয়তো সে অত্যাচার মানুষিক থেকে শারীরিক পেঁৗছে যায়। অসহায় মেয়েটির বোবা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। পিতৃলয়ে এলে বাবা-মা বলে স্বামীর ঘরই আসল ঘর। ‘গিয়েছিস বধূ হয়ে ফিরবি লাশ হয়ে’। মেয়েটি জীবন্ত লাশ হয়ে আবার ফিরে যায় প্রকৃত লাশ হওয়ার জন্য। যৌতুকের জন্য নিযার্তন দেখতে দেখতে আর শুনতে শুনতে এখন কোনো গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের কথা শুনলেও মনে হয় সবই ভাগ্য। পুরুষবাদীরা বলে নিশ্চয় দোষ ছিল, না হলে কি এমন হয়...! শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষিত চাকরিজীবী ভদ্র মেয়েটিও পুরুষশাসিত সমাজের রোষানল থেকে বাদ পড়ে না। ‘পতিদেব’ বাইরে পরনারী আসক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। স্ত্রী জবাব চাইলে বলে ঘরে সুখ নাই তাই বাইরে খুঁজি। শাশুড়ি বলবে তোমার স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই তাই বাইরে যায় আমার ছেলে। চাকরি ছেড়ে সংসার কর আর শোনো এবার আমাদের নাতি চাই নইলে কিন্তু আমরা আবার ছেলে বিয়ে দেব। ওদিকে বাহিরটানে স্বামীর কাছে বিষ হয়ে থাকা মেয়েটি প্রতিদিন শিকার হয় মানুষিক ও শারীরিক নিযার্তনের কখনো প্রতিবাদ করলে তাকে হতে হয় লাঞ্ছিতা। সমাজ বলবে চাকরি করে তো তাই দেমাগি। শ্বশুড়বাড়ির লোক বলবে তালাক দাও তেজ কমবে আর সুযোগসন্ধানী স্বামী দেবতা তালাক পাঠিয়ে নিজের ক্ষমতার বাহাদুরি দেখাবে। মানসিক ও শারীরিক নিযাির্ততা মেয়েটি যখন বাপের বাড়ি আসবে তখন বাপ বলবে লেখাপড়া শিখিয়েই ভুল করেছি। ছোটবেলায় বিয়ে দিয়ে দিতাম, শুধু ঘর-সংসার করতো তাহলে স্বামীর পায়ের নিচে থাকতো। প্রতিবাদ করে আজ এদশা হতো না। মা করুন সুরে কঁাদবে আর বলবে তুই আমাদের মান-সম্মান সব ডুবালি। তোর জন্য সবার কাছে মুখ দেখাবো কি করে! ভাই বলবে, মাদ্রাসায় পড়ালে আজ এদিন দেখতে হতো না। মোবাইল-ফেসবুক এসব ব্যবহার করার কি দরকার। স্বামীর কথামতো রীতিমতো সংসার করতো-ঘর সামলাতো তাহলে এসব হতো না। এত বেহায়াপনার কি দরকার? বোন বলবে তোর জন্য আমার স্বামীও সাহস পেয়ে যাবে, নিজের সংসারটাই ঠিক রাখতে পারলি না? কেউ বুঝবেনা মেয়েটির কথা, সেও একটি মানুষ তারও ব্যক্তিত্ব আছে, মন আছে। তারপর যদি মেয়েটির কোনো কন্যাসন্তান থাকে তাহলে সেটি হবে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। সমাজ আঙ্গুল তুলবে কন্যাসন্তানটির দিকে। এত ঝড়ের ভেতর কীভাবে মেয়েটি দিন পার করে তার হিসাব কেউ রাখে না। জীবনের তাগিদে সব মেনে নিতে হয়তো স্বাভাবিক হয় মেয়েটি। অভিনেতা হয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাকে। শতকষ্টেও মুখে শুধু হাসি টেনে বলতে হয় ভালো আছি। আসলেই কি সে ভালো আছে বাপ-ভাইয়ের সংসারে? কেন এমন হলো তার জীবন? কী তার ভুল! সে নারী এই তার অন্যায়? সমাজের কাছে, পুরুষ মানুষের কাছে সে মানুষ না ‘মেয়ে মানুষ’ যে হাসিমুখে সারাজীবন সব নিযার্তন সয়েও বলবে ভালো আছি।