সংসার সন্তান না চাকরি

নারী যখন মা হয় তখন সন্তানকে পরিবারের কারও কাছে রেখে নিশ্চিন্তে কমের্ক্ষত্রে যাওয়ার সুযোগ থেকে একক পরিবারের নারীরা বঞ্চিত হয়। ফলে কোনো এক সময় সন্তানের কথা ভেবে অনেক নারীকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও চাকরি ছাড়তে হয়...

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মাসুমা রুমা
অথর্নীতিতে নারীর অবদান ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। কমের্ক্ষত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে নারীর অংশগ্রহণ। তবু কমর্জীবী নারীদের সহস্রাধিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে কমর্জীবী মায়েদের ভোগান্তির অন্ত নেই। ব্যক্তিগত আথির্ক সচ্ছলতা, নাগরিক হিসেবে দেশের অথর্নীতিতে অবদান রাখা কিংবা পরিবারের সচ্ছলতার কথা চিন্তা করে নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নারীরা কমের্ক্ষত্রে প্রবেশ করে। কিন্তু নিজেদের শ্রম, ত্যাগ ও অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন সে অথের্ পায় না নারীরা। নারীদের কমের্র উপযুক্ত মূল্যায়ন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এই স্বীকৃতির জন্য নারী-পুরুষ উভয়েরই দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবতর্ন জরুরি। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে একক পরিবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অথচ একক পরিবার প্রথা বতর্মানে নিজেই সমস্যার কারণ হয়ে দঁাড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করার চেষ্টা করব। একজন কমর্জীবী নারী যখন গভর্ধারণ করেন, তিনি হয়তো সংক্ষিপ্ত মাতৃকালীন ছুটি পেয়ে থাকেন। যেটাকে মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। কিন্তু ছুটি শেষ হতেই কমের্ক্ষত্রে তাকে যথা নিয়মে যোগদান করতে হয়। মা বা শিশুর যত সমস্যাই থাকুক না কেন। অন্যথায় তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। একজন মা হবার পর নারীর দায়িত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। একদিকে সংসার, চাকরি অন্যদিকে সন্তান। সবকিছু সামলে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয় নারীদের। সন্তানকে কাজের লোকের কাছে রেখে স্বস্তিতে থাকতে পারেন না মা। সেখানে বিপদের সম্ভাবনা ও যতেœর অধিক ত্রæটি লক্ষ্য করা যায়। কমর্জীবী নারীদের কথা ভেবে রাজধানীতে চালু করা হয়েছে বেশ কিছু ডে কেয়ার সেন্টার। কিন্তু সেখানে শিশুদের আদর, স্নেহ, ভালোবাসার ব্যাপারে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। সুতরাং ডে কেয়ারগুলো কমর্জীবী মায়েদের কিছুটা স্বস্তির কারণ হলেও পুরোপুুরি না। তবু অবস্থান আর পারিপাশ্বির্ক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানের কথা ভাবতে হবে। কমর্জীবী মায়েরা যেন স্বস্তিতে কমের্ক্ষত্রে তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করে যেতে পারেন, সে জন্য দুটি সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রথম সম্ভাব্য সমাধান : (পুনরায় যৌথ পরিবার প্রথা চালুকরণ) যৌথ পরিবার এখন কেবলই স্মৃতির অংশ হয়ে দঁাড়িয়েছে। যদিও আজও গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। পরিবার মায়ামমতা ভালোবাসার বঁাধন। ‘একতাই শক্তি’ পরিবার অপেক্ষা এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি মিলবে না। বতর্মানে একক পরিবার গঠনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন আধুনিক নর ও নারী। শেকড় থেকে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে অনেকাংশই। একক পরিবার মূলত স্বামী-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গঠিত হয়। এর বাইরেও দুই একজন সদস্য থাকতে পারে। এমন পরিবারের একজন নারী যখন কমর্জীবনে প্রবেশ করতে চায় তখন তাকে নানা ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়। প্রথমত, তাকে অধিক শারীরিক চাপে থাকতে হয়। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান ও যতœ তিনি নিতে পারেন না। কেননা সারাদিনের ক্লান্তি শেষে নিজের দিকে খেয়াল করার মনোভাব তার থাকে না বললেই চলে। পরিবারের কোনো কাজেই তাকে সহযোগিতার কেউ থাকে না। সবকিছু এক হাতে সামলাতে হয়। দ্বিতীয়ত, তিনি মানসিক চাপে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কমর্জীবনে সমপরিমাণ পরিশ্রম করলেও অধিকাংশ পুরুষ-স্ত্রীর পরিশ্রম, ত্যাগকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ফলে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব বাড়ে, যা একজন নারীকে প্রতিনিয়ত ‘সংসার না চাকরি’ এই দ্বিধায় ফেলে দেয়। তাকে মানসিক চাপমুক্ত রাখার জন্য, ভালো পরামশের্র দেয়ার জন্য, গল্প-আড্ডার জন্য হলেও দু’একজন মানুষ পাশে থাকা জরুরি হয়ে পড়ে। একক পরিবারে নারী সে সুযোগ পান না। তৃতীয়ত, নারী যখন মা হয় তখন সন্তানকে পরিবারের কারও কাছে রেখে নিশ্চিন্তে কমের্ক্ষত্রে যাওয়ার সুযোগ থেকে একক পরিবারের নারীরা বঞ্চিত হয়। ফলে কোনো এক সময় সন্তানের কথা ভেবে অনেক নারীকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও চাকরি ছাড়তে হয়। সুতরাং পুনরায় যৌথ পরিবার প্রথাকে জনপ্রিয় করে তুলে আমরা কিছুটা হলেও কমর্জীবী মায়েদের সমস্যা লাঘব করতে পারি। নারীর স্বপ্নগুলোকে বঁাচিয়ে রাখতে পারি। তবে এক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর ইচ্ছাশক্তিই যৌথ পরিবার প্রথাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। দ্বিতীয় সম্ভাব্য সমাধান : (ডে কেয়ারগুলোর মানোন্নয়ন) ডে কেয়ার সেন্টার আধুনিক সমাজে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়েছে। যদিও একে পরিবারের বিকল্প বলা কোনো দিক থেকেই যুক্তিযুক্ত হবে না। তবুও এর গুরুত্ব একেবারে অস্বীকার করার পথও খোলা নেই। রাজধানীর আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা অধিকাংশ ডে কেয়ার সেন্টারগুলোতে চাহিদার তুলনায় সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। শিশুদের তত্ত¡াবধায়নের জন্য যেসব নারীকে নিয়োগ দেয়া হয়, সাধারণত তারা অল্প শিক্ষিত হয়ে থাকেন। কেউ আবার অন্যত্র ভালো চাকরি পেয়ে গেলে ডে কেয়ার ছেড়ে চলে যান। ফলে অল্পশিক্ষিত নারীদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি, মনোমালিন্য লেগেই থাকে। কেউ কেউ শিশুদের সামনেই অশ্লীল ও আপত্তিজনক শব্দ প্রয়োগ করে থাকেন, যা শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই ডে কেয়ার সেন্টারগুলোর নারী কমীের্দর নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কাউন্সিলিং অধিক জরুরি। এ ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাচ্চাদের মনস্তাত্তি¡ক গঠন সংক্রান্ত সমস্যা তো আছেই। একাধিক শিশু একজনের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণেও অনেক সমস্যা তৈরি হয়। কাজেই এসব প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নের ব্যাপারে আরও অধিক মনোযোগী হওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে দঁাড়িয়েছে। কেননা দিন দিন কমর্জীবী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে একক পরিবার প্রথা। ফলে কমর্জীবী মায়েদের কাছে ডে কেয়ার সেন্টারগুলো অনেকটা ভরসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। ডে কেয়ার সেন্টারের চাহিদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং নারীদের অবস্থানের কথা চিন্তা করে শুধু রাজধানী নয়, বেশব্যাপী ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। এতে অন্তত কমর্জীবী মায়েরা কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কমের্ক্ষত্রে মনোযোগী হতে পারবেন। কাজেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে কতৃর্পক্ষ এ ব্যাপারে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে বলেই আমার বিশ্বাস। নারীরা পুরুষের ন্যায় একটি সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্ন পরিবার কিংবা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়। নারীরা সংসার জীবনে একজন ভালো স্ত্রী হতে চান, হতে চান একজন ভালো মা। কমর্জীবনে হতে চান দক্ষ ও সফল। নাগরিক হিসেবে হতে চান একজন সুনাগরিক। পুরুষের মতো সবক্ষেত্রেই সমান তালে অবদান রাখতে চান। দেশকে নিয়ে যেতে চান সাফল্যের সবোর্চ্চ চ‚ড়ায়। নারীদের এই সুন্দর স্বপ্নকে বঁাচিয়ে রাখতে, বাস্তবায়ন করতে সবার সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন। নারীকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করা জরুরি। তার কাজের নিশ্চয়তা জরুরি। তার অবদানকে স্বীকার করার সহজ-সরল মনোভাব থাকা জরুরি। তাহলে হয়তো আমাদের এই সম্ভাবনাময় দেশটা নারী-পুরুষের হাত ধরে নিদির্ষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারবে একদিন।