সমাজে প্রতিবন্ধী নারীর অবস্থান

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

তাসনিম তপা
সমাজ যখন অধিকারটুকু না দেয়, তখন আইন দিয়েই তা আদায় করে নিতে হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালে প্রথম প্রতিবন্ধী আইন হয় ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন’ নামে। প্রতিবন্ধীদের জন্য এটাই ছিল প্রথম আইনি স্বীকৃতি। পৃথিবীজুড়ে ৬০ কোটির বেশি প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। এর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে রয়েছে আনুমানিক ৫৮-৬৩ শতাংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১০ শতাংশই প্রতিবন্ধী। আমাদের সমাজে কোনো পরিবারে প্রতিবন্ধী কোনো শিশু জন্মালে সেই শিশুকে নিয়ে বাবা-মা খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে যান। শিশুকে নিয়ে ঘর থেকে বের হন না। লোকচক্ষুর আড়ালে তাকে রাখা হয়। এমনকি লুকিয়ে রাখা হয়। কারো কাছে তার কথা বলাও হয় না। এরকম পরিস্থিতিতে তার অধিকারের কথা খুব সহজেই উঠে আসে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রতিবন্ধীবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা (১৯৯৫), বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন (২০০১) এবং প্রতিবন্ধীবিষয়ক জাতীয় কমর্পরিকল্পনা (২০০৬) সংক্রান্ত তিনটি দলিলই অনুমোদিত হয়েছে বিভিন্ন সরকারের একেবারে শেষ সময়ে গিয়ে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী এসব দলিল বাস্তবায়নে পরবতীর্ সরকার তেমন আর আন্তরিক থাকে না। প্রতিবন্ধীবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা হয়েছে ১৯৯৫ সালে। নীতিমালায় সমাজকে হয় নারী-পুরুষ বৈষম্যমুক্ত ভেবেছে, নয়তো প্রতিবন্ধিতার আলোচনাকে বিচ্ছিন্ন বা বিশেষ কোনো বিষয় ভেবেছে। প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ ও জাতীয় প্রতিবন্ধী নীতিমালা ১৯৯৫ এ উভয়ের পূবার্নুমান হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ‘অক্ষম’, এরা ‘বিপদে পড়া’ একটি জনগোষ্ঠী, এরা পারে না, এবং বিষয়টি মূলতই চিকিৎসার একটি বিষয়। ‘বিওয়াকো মিলেনিয়াম ফ্রেমওয়াকর্ ফর অ্যাকশন (বিএমএফ) হলো ২০০২ সালে এসকাপের তৎপরতায় এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য নীতিমালার কাঠামো। এ কাঠামো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি বাধামুক্ত ও অধিকারভিত্তিক সমাজ গঠনে প্রত্যয়ী। বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ : ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। তুমুল বিতকের্র পর প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়গুলো স্বতন্ত্র ধারা (ধারা ৬) হিসেবে অন্তভুর্ক্ত হয় এ সনদে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ এ সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। এর ধারা-৬ এ প্রতিবন্ধী নারী সম্পকের্ বলা হয়েছে : ১. প্রতিবন্ধী নারীরা যে বহুমুখী বৈষম্যের ভুক্তভোগী রাষ্ট্রপক্ষ তা স্বীকার করবে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সব মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার সমান ও পূণর্ উপভোগ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ২. এই সনদে উল্লিখিত সব মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা যেন প্রতিবন্ধী নারীরা পূণর্ মাত্রায় উপভোগ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপক্ষ প্রতিবন্ধী নারীদের সাবির্ক উন্নয়ন, অগ্রসরতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। দলিলটির ধারা-৬ ছাড়াও বেশ কয়েকটি ধারা ও অধ্যায় এ প্রতিবন্ধী নারীর অধিকার ও বৈষম্যহীন জীবনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ধারা-৩ এর ‘সাধারণ মূলনীতি’তে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে : ধারা ১৬-এর আওতায় ‘শোষণ, সহিংসতা ও নিযার্তন থেকে মুক্তি’ অধ্যায়ে ঘরে-বাইরে বিভিন্ন পযাের্য় শোষণ, সহিংসতা ও নিযার্তনের লিঙ্গভিত্তিক মাত্রার প্রতি জোর দিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ধারা ২৩-এর ‘গৃহ ও পারিবারিক জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, এ ধারা অনুয়ায়ী রাষ্ট্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বৈবাহিক, পারিবারিক, পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব ও জ্ঞাতিত্ব সম্পকির্ত সব বিষয়ে অন্য ব্যক্তির প্রতি সমানভাবে বৈষম্য দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ধারা-২৫ এর আওতায় ‘স্বাস্থ্য’ অধ্যায়ে একটি জেন্ডার-সংবেদী স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যজনিত পুনবার্সন নিশ্চিত করার জন্য সবরকম উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে রাষ্ট্রপক্ষকে সুনিদির্ষ্টভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ধারা-২৭ এর ‘কমর্ ও কমর্সংস্থানে’ হয়রানি নিপীড়ন থেকে সুরক্ষার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে এবং ধারা-৩৪ এ বলা হয়েছে, জাতিসংঘে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় যে কমিটি কাজ করবে সেখানে সমান নারী-পুরুষ প্রতিনিধিত্ব করবে। নারী প্রতিবন্ধী নাগরিকের অধিকার, নারী অধিকার, মানবাধিকার। এটি কোনোক্রমেই স্বাস্থ্য বা দয়ার বিষয় নয়। ‘রুলস অব বিজনেস’ নামের আমলাতন্ত্রের জঁাতাকলে পড়ে নারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মানবাধিকার আজ খÐিত অবমাননার মুখোমুখি।