আনোয়ারা বেগম

কেঁচো কম্পোস্ট সার ও বিষমুক্ত সবজির কারিগর

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

এম আর মাসুদ
সংসার, সমাজ, রাষ্ট্রে যা কিছু কল্যাণকর তার অধের্ক নারীর অবদানের কথা কবি, সাহিত্যিক, মনীষীরা বললেও সমাজ, রাষ্ট্রে এমন অনেক নারী আছেন যারা কল্যাণের অধের্ক নয় সবটুকু করেছেন। নারীর এই কমর্দক্ষ যেমন সংসার, সমাজকে করেছে গতিশীল তেমন সংসার নামক যন্ত্রে এসেছে সচ্ছলতা। এসব নারীরা দুঃখ জয়ের পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্রে অনুকরণীয়, অনন্য দৃষ্টান্ত। নারীর এহেন কমর্দক্ষতায় জাগতিক জীবনে একদিকে যেমন সুখ, সচ্ছলতা এসেছে, অন্যদিকে সমাজে আর দশজন নারী অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এমন একজন নারীর নাম আনোয়ারা বেগম (৪৭)। আজ থেকে ২৭-২৮ বছর আগে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়নের বারবাকপুর গ্রামের আব্দুল খঁার সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামী একজন কৃষক। বিয়ের পর থেকে আনোয়ারা সংসারজীবনে ছিল অত্যন্ত মনোযোগী। গৃহস্থালির পাশাপাশি স্বামীর সব কাজে সহযোগিতা করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে আনোয়ারা দুই পুত্রসন্তানের জননী। বড় ছেলে সাদ্দাম হোসেন যশোর পলিটেকনিক্যাল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ঢাকা ডেফোডিল ইউনিভাসিির্টতে বিএসসি করছে। ছোট ছেলে শরিফুল ইসলাম বাংলাদেশ টেকনিক্যাল কলেজে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন। ২০১৪ সালে আনোয়ারা বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষের ওপর এসসিডিপির ট্রেনিং করার পর তার জীবনচক্র অনেকটাই পাল্টে যায়। বাড়ির আঙিনায় বেড করে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন, গবাদিপশু ও হঁাস-মুরগি পালনসহ কেঁচো কম্পোস্ট (ভামির্ কম্পোস্ট) ও চালা কম্পোস্টের মাধ্যমে সার উৎপাদন করে আথির্কভাবে লাভবান হচ্ছেন। আনোয়ারা বেগমের এই কৃষিবান্ধব অথৈর্নতিক কমর্কাÐ দেখে এলাকার অনেক নারী উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তার বসতভিটার এক ইঞ্চি জমিও পতিত নয়। বিঘা খানেক বসতভিটায় আনোয়ারা পরিকল্পিতভাবে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করছেন। যার মধ্যে আটটি বেড তৈরি করে চাষ করছেন বেগুন, গিমা কমলা, সবুজ শাক, মরিচ, ওল, শসা, করলা ও মৌসুমী সবজি শিম, চিচিঙ্গা ইত্যাদি। তিনটি মাচা করে লাউ, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, মেটে কুমড়া, মিষ্টি করলা ও বাড়ির চারপাশের বেড়ায় মিঠা পোল্লা ও ঝিঙে লাগিয়েছেন। অফলা গাছ চালকুমড়া এবং মিষ্টিকুমড়ার লতা ও ফলে ভরে থাকে সারা বছর। টিউবওয়েলের পানি গড়ানোর নিচু জায়গায় লতিকচুর চাষ। ছায়াযুক্ত জায়গায় ঘ্যাটকোল, মানকচু ও আদার সবুজ পাতায় নজর কাড়া নয়নাভিরাম দৃশ্য। আনোয়ারার বসতভিটায় রয়েছে সব ধরনের ফলের গাছ। যার মধ্যে আম, জাম, জামরুল, লিচু, বেল, সফেদা, বরই, বাতাবি লেবু, জাম্বুরা, শজিনা, কমলা, মাল্টা, আনারস, কঁাঠাল, নারিকেল, কামরাঙ্গা, জলপাই, পেঁয়ারা, পেঁপে, কলা, ডুমুর, সুপারি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আনোয়ারা জানান, তার স্বামীর সাত বিঘা আবাদযোগ্য জমি রয়েছে। এসব জমিতে তারা স্বল্পমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেও মূলত গুটি ইউরিয়া সার ও তার নিজের উৎপাদিত কেঁচো কম্পোস্ট (ভামির্ কম্পোস্ট) এবং চালা কম্পোস্টের সার ব্যবহার করেন। কীটপতঙ্গ ও বালাইনাশক হিসেবে কীটনাশকের পরিবতের্ মেহগনির তেল, খৈল, ভাটির পাতা, তুলসীপাতা, নিমের পাতা, ঢোলকলমি, বাশকের পাতা, নিম ও পাটের বীজ ইত্যাদি জৈব ভেষজের নিযার্স থেকে রোগবালাই প্রতিষেধক নিজেরা তৈরি করে ফসলে প্রয়োগ করেন। এতে অনেক সুফল পাওয়া গেছে। আনোয়ারা আরও জানান, তাদের উৎপাদিত তরকারি যেমন টাটকা তেমনি খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। সেকারণে সচেতন ক্রেতারা আমাদের বিষমুক্ত সবজি বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে যায়। আনোয়ারা বেগম গবাদিপশু, হঁাসমুরগির ও কবুতরের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বধর্নশীল জাতের ক্যাম্বেল হঁাস পালন করেন। তবে আনোয়ারার বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি কেঁচো কম্পোস্ট (ভামির্ কম্পোস্ট) সার-কারখানায় মাসিক আয় বেশি হচ্ছে। তার কারখানায় প্রতি নান্দায় প্রতি মাসে তৈরি হচ্ছে ১০-১২ কেজি জৈব সার। আনোয়ারার কারখানায় নান্দা রয়েছে ১০৪টি। নিজের সংসারে খরচ জোগানোর পাশাপাশি ছেলেদের লেখাপড়ায় আথির্ক জোগান দেন তিনি। এক বছর আগে ১০০ গ্রাম কেঁচো দিয়ে দুটি নান্দায় দুই ঝুড়ি গোবর সার দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল আনোয়ারার কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি। তা দেখে অনেকেই আবার নিজেই এই কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরিতে ঝুঁকেছেন। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ওই এলাকার বøকের উপসহকারী কৃষি কমর্কতার্ আইয়ুব হোসেন দেড়শ টাকা দিয়ে ১০০ গ্রাম কেঁচো কিনে দিয়েছিলেন। দুটি নান্দা কিনে সেই কেঁচো দিয়ে দুই ঝুড়ি গোবরের মাধ্যমে জৈব সার তৈরি শুরু করেছিলেন আনোয়ারা বেগম। তা থেকে প্রথম বছরে যে সার তৈরি হয়েছিল সেটা তার স্বামী আব্দুল খঁা জমিতে ব্যবহার করেছিলেন। সেই ১০০ গ্রাম কেঁচো থেকে বতর্মান আনোয়ারার ১০৪টি নান্দায় কেঁচো রয়েছে ১২-১৫ কেজি। এক কেজি কেঁচোর দাম ১৫০০/- টাকা। আনোয়ারা এ বছর কেঁচো কম্পোস্ট (ভামির্ কম্পোস্ট) সার তৈরির জন্য একটি চালা (সেড) তৈরি করেছেন। সে জানিয়েছেন ১০৪টি নান্দার জন্য চালা তৈরি, মাচা, বেড়া ও ছাউনি ঘেরা দিয়ে মোট খরচ হয়েছে ১৩-১৪ হাজার টাকা। আনোয়ারার সংসারে দুটি গরু আছে। ফলে তাকে গোবর কেনা লাগে না। প্রতিটি নান্দায় ২০০ গ্রাম কেঁচো আর এক ঝুড়ি গোবর দিলে তা থেকে ১৫-২৫ দিনের মাথায় ১২-১৩ কেজি জৈব সার পাওয়া যায়। এক কেজি জৈব সারের দাম ১৫/-। পাশাপাশি প্রতি নান্দা থেকে ২-৩ মাস অন্তর ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি করে কেঁচো বিক্রি করা যায়। আনোয়ারার কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরিতে এলাকায় এই সারের কদর বেড়ে গেছে। প্রতিমাসে তার আয় ১০-১২ হাজার টাকা। তার ছোট ছেলে শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, মায়ের বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে তারা যেমন গবির্ত, তেমনি মায়ের কেঁচো কম্পোস্ট (ভামির্ কম্পোস্ট) সার তৈরিতে যে অতিরিক্ত অথর্ আয় হয় তা দিয়ে তাদের দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগানো অনেকটাই সহজ হয়েছে।