আথর্-সামাজিক উন্নয়নে আমাদের মায়েরা

মাত্র সাড়ে ৫৬ হাজার বগর্মাইলের দেশটিতে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। যার অধের্কই আমাদের মায়েরা। এখানে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত মায়েরা পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে লড়ে যাচ্ছে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই দারিদ্র্যসীমার নিচে। কেউ কেউ আবার চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে...

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

মুহাম্মদ কামাল হোসেন
‘মা’-মানব ইতিহাসের গোড়াপত্তন থেকে অতি গুরুত্বপূণর্ ও জনপ্রিয় একটি শব্দ। মায়ের কাছে সন্তানের কোনো তুলনা হয় না। পরম যতœ আর বিগলিত ভালোবাসায় প্রতিটি মা তার সন্তানকে বুকে আগলে রাখেন। জন্মভ‚মি মায়ের মতো বলেই তার আরেক নাম-মাতৃভ‚মি। এখানেও মা তার ভ‚মিকে সন্তানের মতো নানারকম সমস্যা ও দুযোর্গ থেকে বুকে আগলে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। সুজলা-সুফলা ও শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। বিশ্ব মানচিত্রে স্বীয় যোগ্যতায় স্থান করে নেয়া ছোট্ট একটি দেশ। আকার আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশকে চ্যালেঞ্জ করা যেতেই পারে। মাত্র সাড়ে ৫৬ হাজার বগর্মাইলের দেশটিতে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। যার অধের্কই আমাদের মায়েরা। এখানে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত মায়েরা পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে লড়ে যাচ্ছে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই দারিদ্র্যসীমার নিচে। কেউ কেউ আবার চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। যদিও আমাদের জাতীয় কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান।’ এখানে কবি দারিদ্র্যকে মহান ও খ্রিস্টের সম্মানে অধিষ্ঠিত করলেও এটি মূলত বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। শুধু তাই নয়Ñ দারিদ্র্য জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে বিরাট অন্তরায় এবং বিভিন্ন অসামাজিক কাযার্বলির উৎসকেন্ত্র। দারিদ্র্য এক ধরনের অভিশাপও। তাই বোধ করি, কবি সুকান্ত ভট্টাচাযর্ কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ‘কবিতায় তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়; পূণির্মার চঁাদ যেন ঝলসানো রুটি। ‘দারিদ্র্যের কারণে বাংলাদেশের আথর্-সামাজিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বছর বছর বিশ্ব জলবায়ুর কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপযের্য়র পাশাপাশি বিবাদমান রাজনৈতিক দুযোর্গ ও দেউলিয়াপনার কারণে স্বাধীনতা পরবতীর্ ৪৬ বছরেও কাযর্ত দেশটি খুব একটা এগিয়ে আসতে পারেনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও নকল, ধারাবাহিক প্রশ্নপত্র ফঁাস, কোচিং বাণিজ্য, মানহীন সিলেবাসব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে শিক্ষাব্যবস্থা এখনো কাযর্ত প্রশ্নের মুখে। মানুষ এখানে প্রতিনিয়ত ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর পাল্লা ভারী হচ্ছে, অন্যদিকে দেশে ক্রমবধর্মান হারে চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, দুনীির্ত কিংবা জঙ্গিবাদ নামক মহামারীর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। জঙ্গিবাদের নীল ছোবলে বারবার আক্রান্ত হচ্ছে সবুজ-শ্যামলে আচ্ছাদিত আমাদের এ প্রিয় জন্মভ‚মি। যার কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ অব্যাহতভাবে কমে যাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন আন্তজাির্তক দাতাগোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানগুলো। আস্থার সংকট ও ব্যবসা-বিনিয়োগের অনুক‚ল পরিবেশের অভাবে বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছে না বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অথর্লগ্নি সংস্থাগুলো। পদে পদে হেঁাচট খাচ্ছে আমাদের জাতীয় অথর্নীতি, মুখ থুবড়ে পড়েছে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি। বৈদেশিক রেমিট্যান্সও কাক্সিক্ষত মানে নেই। বিদেশে শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন, ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, ছঁাটাইকরণ ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা ওদের নিত্য ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। জাতি স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও অন্যায়-অবিচার, দুনীির্ত ও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গিবাদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারছে না। ফলে দরিদ্রতা হু হু করে বেড়েই চলেছে। দরিদ্রতার অভিশাপের কষাঘাতে আবদ্ধ দেশের এ বিশাল জনগোষ্ঠী জনসম্পদ না হয়ে জনসমস্যারূপে বিরাজ করছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশে জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। সব ধমার্বলম্বীরা এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যুগ যুগ ধরে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। শুধু ধনী-গরিবের ব্যবধানটুকু এসব অজর্নকে ¤øান করে দিচ্ছে। একদিকে দশ তলার সুরম্য প্রাসাদ অন্যদিকে বস্তির পর বস্তি। কেউ সহায় সম্পদ, অথর্ বৈভবের পাহাড় গড়ে তুলেছে, আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসী জীবনাচারে মত্ত থাকছে। আর কেউ ধনীদের গড়া সম্পদের পাহাড়ের পাদদেশে, অলিতে-গলিতে মাথা গেঁাজার শেষ আশ্রয়টুকু খুঁজছে। অধার্হার-অনাহারে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আজ হাওর এলাকায় হাজারো অসহায় পরিবারের বুকফাটা কান্না আতর্নাদ পরিবেশকে শুধু ভারীই করে তুলেছে। এ ঘোর দশা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের একার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। বিশেষত আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটা আরও সত্য। সরকারের পাশাপাশি পরিপূরক হিসেবে বেসরকারি সংস্থাগুলো উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করতে পারে। আমাদের মায়েরা এ কাজে গুরুত্বপূণর্ ভ‚মিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ মায়েরা এখন আর বসে নেই। তারা ইতোমধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবাদি পশু-পাখি পালন, পোল্ট্রি ফামর্, শাক-সবজি ফলন, ফলচাষসহ বিভিন্ন উৎপাদননিভর্র কমর্কাÐের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও আথর্-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূণর্ ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছে। নিজেদের পরিবার-পরিজনের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, ওদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে। দেশের অথর্নীতির একটি চাকা যদি পুরুষে গতিশীল রাখছে, পাশাপাশি মায়েরাও অন্য একটি চাকা সচল ও গতিশীল রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। হাজারো মায়েরা আজ স্বাবলম্বী হচ্ছে। সংসারে পুরুষের পাশাপাশি সমান অবদান রাখছে ও উপাজর্ন করছে। একজনের দেখাদেখি অপরাপর মায়েরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। নিভৃত গ্রাম পল্লীতে গড়ে তুলেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্ত্র ও বুটিকশিল্প। কেউ গবাদি পশু-পাখি লালন-পালনে ঝুঁকছে আবার কেউ কৃষিজ চাষবাসে। দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও আথর্-সামাজিক উন্নয়রের পাশাপাশি দেশের অথৈর্নতিক বুনিয়াদ গঠনে পাল্লা দিয়ে সমাহারে কাজ করছে। আমাদের মায়েরা আজ দেখিয়ে দিচ্ছে তারা দেশের উন্নয়নে কতটা ভ‚মিকা রাখতে পারে। আমাদের মায়েদের সম্ভাবনাও প্রবল। তাদের কোমল হাতের শৈল্পিক ছেঁায়ায় যে কোনো জটিল ও কঠিন কাজ নান্দনিকতায় ছেয়ে যায়। কোনো মাকে অবহেলা আর অবজ্ঞা করা যায় না। একটি আদশির্ক, ক্ষুধামুক্ত, অসম সমাজ ও সুখীসমৃদ্ধ রাষ্ট্র বিনিমাের্ণ মায়েদের কোনো বিকল্প নেই। পুরুষের সমসংখ্যক কাজ তারাও সমান দক্ষতায় করতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে মায়েরা ঘর ও ঘরের বাইরে দ্বিগুণ কাজ করে থাকে। যদিও কমের্ক্ষত্রে তারা বেতন বৈষম্য, প্রবঞ্চনা ও যৌন হয়রানিসহ নানারকম সমস্যার শিকার হতে দেখা যায়। তাই আজ মায়েরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন কাজে সফল হচ্ছেন। দেশের কাক্সিক্ষত জিডিপি বা প্রবৃদ্ধি অজের্নর লক্ষ্যমাত্রায় কাযর্কর ভ‚মিকা রাখছে। দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও আথর্-সামাজিক উন্নয়নে তাদের অবদানকে এখন আর ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের কমের্ক্ষত্রকে অধিকতর অবাধ উন্মুক্ত ও নিষ্কণ্টক করে দিতে হবে, পাশাপাশি মায়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও কাযর্কর পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য জনসচেনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে সবাের্গ্র এগিয়ে আসতে হবে।