আমাদের নারী ভাষাসৈনিকরা

প্রকাশ | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

রুমানা নাওয়ার
'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নারীরা। পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ভাষার দাবির মিছিলগুলোতে নারীরা ছিল সামনের কাতারে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সালাম, জব্বার, রফিক, শফিকসহ অনেকেই। ভাষা আন্দোলনে মেয়েদের দৃশ্যমান ভূমিকাগুলোকে কিছুৃ কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে একে চরম অবহেলা বা অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে তথ্যানুসন্ধানের এক পর্যায়ে দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত শরীফা বুলবুল এর লেখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী এখানে সন্নিবেশিত হলো। আন্দোলন ও সংগ্রামের সুতিকাগার বলে খ্যাত কুমিলস্নার এক সংগ্রামী নারী অধ্যাপিকা লায়লা নূর। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার পদচারণা অবিস্মরণীয়। তিনি ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখেন ১৯৪৮ সাল থেকে বায়ান্নর সব আন্দোলনেই তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকে লায়লা নূর ভাষার জন্য আন্দোলনে যোগ দেন। তার জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ অক্টোবর কুমিলস্নার দাউদকান্দি উপজেলার গাজীপুর গ্রামে। ১৯৫৭ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রম্নয়ারি পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে নির্যাতনের শিকারও হতে হয় তাকে। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ভাষাসংগ্রামী লায়লা নূর আজো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হওয়ার বেদনা নিয়ে বেঁচে আছেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন ছাত্রজনতা আন্দোলন শুরু করেন তখন দাবানলের মতো প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। ২২ ফেব্রম্নয়ারি থেকে নড়াইলেও শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। সে দিন ছাত্র-জনতা আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য সব ছাত্রীকে আহ্বান জানালে নড়াইলে মাত্র তিনজন নারী একাত্মতা ঘোষণা করেন ও মিছিলে যোগ দেন। তারা হচ্ছেন- সুফিয়া খাতুন, রিজিয়া খাতুন ও রুবি। রিজিয়া খাতুন, তাদেরই একজন যিনি এত বছরেও রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি। ফেনী মহকুমার শশ্মদি ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামে নারী ভাষা সৈনিক শরিফা খাতুন (১৯৩৬ সালের ৬ ডিসেম্বর) এর জন্ম। তার কাছে জানা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে ভাষার দাবির বিভিন্ন স্স্নোগান সংবলিত পোস্টার আঁকত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে নারীরাই পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙে। আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা। আহতদের চিকিৎসা সাহায্যের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েরা চাঁদা তুলে আনে। পুলিশের তাড়া খাওয়া ছাত্রদের নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখে। আন্দোলনের খরচ চালানোর জন্য অনেক গৃহিণী অলঙ্কার খুলে দেন। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় অনেক নারীকে জেলও খাটতে হয়েছে। কেউ হারিয়েছেন সংসার। কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হয়েছেন বহিষ্কৃত। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীদের অনবদ্য ভূমিকা ছিল। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে বাংলাভাষার দাবিকে চাঙ্গা করতে গঠিত হয় 'তমুদ্দিন মজলিস'। আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলা, বোন রহিমা এবং রাহেলার ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া আন্দেলনকারীদের আজিমপুরের বাসায় দীর্ঘদিন রান্না করে খাইয়েছেন। শুধু তাই নয়, বায়ান্নর ২৩ তারিখ রাত ৪টার দিকে আবুল কাশেমের বাসা ঘিওে ফেলে পুলিশ। ভেতরে আবুল কাশেম ও আব্দুল গফুরসহ অন্যরা ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র ' সৈনিক' পত্রিকা প্রকাশের কাজে ব্যস্ত। পুলিশ দরজায় বারবার আঘাত করলে মিসেস রাহেলা কাশেম, ফ্যামিলি বাসায় রাতে পুলিশ প্রবেশের চেষ্টার বিরুদ্ধে পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘ তর্কবিতর্ক জুড়ে দেন। এ সুযোগে আবুল কাশেমসহ অন্যরা পেছনের দেয়াল টপকে পালাতে সক্ষম হন। এরপর পুলিশ ভেতরে ঢুকে কাউকে দেখতে না পেয়ে চলে যায়। ভাষা আন্দোলন শুরুর দিকে অন্দরমহলে নারীর এই অবদান আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলো এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কারণ সেই রাতে আবুল কাশেমসহ অন্যরা গ্রেপ্তার হয়ে গেলে প্রচারপত্র হয়তো থেমে যেত। ১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ছাত্রীদের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, 'বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে।' আন্দোলনের শুরুর দিকে একজন ছাত্রীর মুখে এমন সাহসী উচ্চারণ কর্মীদের মনে উদ্দীপনা জোগাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।