অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ববোধ

প্রকাশ | ১১ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

মাসুদ আনসারী
অভিভাবকদের প্রায় অনেকটা সময় কাটে শিশুদের নিয়ে। এত উদ্যোগ, পরিকল্পনা, আশা, স্বপ্নের বিশাল অংশজুড়েই আছে শিশু। যে পরিবারে শিশু নেই সে পরিবারে যেন বিশাল একটি অপূর্ণতা রয়ে যায়। সুখী পরিবারের প্রাণই হচ্ছে শিশুরা। পরিবারের এই ছোট্ট পরিবেশকে মাতিয়ে রাখতে শিশুদেরই প্রয়োজন বেশি। এত ভালোবাসা ঘিরে থাকে যে শিশুদের নিয়ে তাদের লালন করে বড় করে তোলা কিন্তু এত সহজ নয়। শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টিতে অভিভাবকের দায়িত্ব অনেক, এই দায়িত্ব অভিভাবকরা কতটুকু পালন করতে পারে! শিশুরা ইচ্ছে করেই অপরাধী/অবাধ্য হতে চায় না। একজন শিশু অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ অভিভাবকদের দায়িত্ব ও সচেতনহীনতা। \হশিশুরা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। তাদের জীবনে ফিরে আসে নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা। তখন তাদের মধ্যে সবকিছু বিবেচনা করে গ্রহণ করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। এ সময় তাদের স্বাধীনতা বোধটিও বাড়তে থাকে। মা-বাবার নিয়ম-নীতির সীমাবদ্ধতা, নিজস্ব ব্যক্তিসত্তার সীমাবদ্ধতা ঘিরে এই স্বাধীনভাবে চলার মনোভাবটি গড়ে ওঠে। এটা তাদের বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তখন অভিভাবকরা এই উপলব্ধিটা বুঝতে না পেরে শিশুদের এই স্বাধীনতাকে অভদ্রতা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। তারপর কিছু বিবেচনা না করে তাদের নিয়মনীতি আরো কড়া করে শিশুদের এই স্বাধীনতাকে পোষ মানানোর চেষ্টা করে থাকে। এইটি কিন্তু একজন শিশুর সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। হঁ্যা, তখন তারা শিশুদের এই স্বাধীনতাকে অভদ্রতা হিসেবে নিতে পারে, যখন শিশুরা মা-বাবার স্বাভাবিক নিয়মনীতি এবং নিজেদের ব্যক্তিসত্তার নিয়মনীতি গন্ডি অতিক্রম করে মাত্রাতিরিক্ত ছাড়িয়ে যায়। শিশুরা যদি মা-বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিতে থাকে, তাহলে সে হবে তার মা-বাবার ব্যক্তিত্বের হুবহু কপি। কিন্তু কখনো তা কাম্য নয়। মানবজাতির বিকাশে প্রয়োজন নতুন নতুন মানুষের, যারা সবখানে ছড়িয়ে দেবে নতুনত্বের ছোঁয়া। নতুন করে সাজাবে সমাজ, দেশকে। চাকরির ব্যস্ততা বা অন্যান্য কারণে অনেক অভিভাবক শিশুদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে পারে না। যার ফলে শিশুদের মাঝে অসহায়ত্ববোধ বাড়তে থাকে এবং অবাধ্য শিশু হওয়ার সম্ভাবনাও ধীরেসুস্থে বাড়ে। তাই অভিভাবকের উচিত শিশুদের সঙ্গে নূ্যনতম সময় হলেও কাটানোর চেষ্টা করা। শিশুরা খারাপ আচরণ করলে তার প্রতিদান যেমন শাসনের দ্বারা দেয়া হয়, ঠিক তেমনি শিশুরা যদি ভালো আচরণ করে তার প্রতিদানও দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে তারা ভালো আচরণে প্রতি উদ্বুদ্ধ হবে, ভালো মানুষ হয়ে উঠবে। শিশুদের অনেক চাওয়া-পাওয়ার থাকে। যদি তা পূরণ করার সামর্থ্য অভিভাবকদের পক্ষে সম্ভব না হয়, তাহলে তার পরিবর্তে আরেকটি প্রস্তাব দিলে ভালো হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অভিভাবকরা একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে শিশুদের নতুন কিছু (ল্যাপটপ, কম্পিউটার, সাইকেল) ইত্যাদি কিনে দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে থাকে। কিন্তু অভিভাবকরা সেই প্রতিশ্রম্নতি রাখতে পারে না। যদি সামর্থ্য বা সক্ষমতা না থাকে তাহলে সেই প্রতিশ্রম্নতি না দেয়াই ভালো। তা না হলে শিশুদের মধ্যে না পাওয়ার আক্ষেপটা চেপে ধরে, অবাধ্য সন্তান হতে অনুপ্রাণিত করে। পড়াশোনার ব্যাপারে শিশুদের বাড়তি চাপ না দেয়াই ভালো। সবার মেধা কিন্তু সমান না, এটি অভিভাবকদের বিবেচনা করা উচিত। এখন অভিভাবকদের মাঝে এক ধরনের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে, কার সন্তান কত ভালো রেজাল্ট করতে পারে। পাশের ফ্ল্যাটের ছেলের ভালো রেজাল্টের বরাত দেখিয়ে শিশুদের অভিভাবকরা বকাঝকা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে শিশুরা মারাত্মক মানসিক চাপে পড়ে, পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকে। তাই অভিভাবকদের অন্তত এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে, প্রয়োজনমাফিক শিশুর মেধা বিকাশে সহযোগিতা করতে হবে। অতিরিক্ত চাপ শিশুর ওপর লেলিয়ে দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। খেলাধুলার ব্যাপারে অভিভাবকদের থাকতে হবে একেবারেই স্বচ্ছ। দেখা যায়, অভিভাবকরা শিশুদের নিয়মিত খেলাধুলা করার সুযোগটাও করে দিতে চায় না। তাদের ধারণা, অযথা খেলাধুলায় সময় নষ্ট না করার চেয়ে এ সময় পড়াশোনাই করা ভালো। কিন্তু একজন শিশুর শারীরিক গঠন এবং মানসিক বিকাশে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। \হঅভিভাবকদের উচিত অন্তত শিশুদের ঘরের চার দেয়ালে আটকে না রেখে খেলাধুলার সুযোগ করে দেয়া। সন্তানের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করা প্রত্যেক অভিভাবকের অন্যতম কর্তব্য। প্রয়োজন হলে বন্ধু সবাইকে মাঝে মাঝে বাসায় আমন্ত্রণ জানাতে হবে। তাদের খারাপ-ভালো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে হবে, সৃজনশীল কাজে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এই কর্তব্য যথাযথ পালন নিশ্চিত করতে পারলে বন্ধুদের আবেগে প্ররোচিত হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়া অনেকটাই কমিয়ে আসবে। শিশুদের নিয়ে অভিভাবকদের হতে হবে আরো সচেতন এবং সজাগ। শুধু নিজেদের মধ্যে এই সচেতনতা লালন করলে দায়িত্ব শেষ নয়, অন্যদেরও মাঝেও এই সচেতনতা বাড়ানোর গুরুদায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে। তাহলেই আপনাদের প্রত্যাশিত উজ্জ্বল একটি প্রজন্মের জন্ম হবে আমাদের দেশে।