মার্চের কালো আকাশ লাল জমিন

প্রকাশ | ১৮ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

তাসনীম নাহের
মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তেমনই কেড়ে নিয়েছে বহু বুদ্ধিজীবী, আত্মার আত্মীয়দের। বহু নারী হয়েছেন স্বামী, সন্তান হারা। অনেকের কাছেই যুদ্ধের স্মৃতি হয়ে উঠেছে এক তমসাচ্ছন্ন রাত্রি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক। দেশের ভেতরে ও বাইরে শরণার্থী ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা, চাঁদা তোলা, ওষুধ, খাবার, কাপড় সংগ্রহ করা, ক্যাম্পে ক্যাম্পে রান্না করা, সেবা করা, চিকিৎসা করা, অস্ত্র শিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবে কাজ করা, এমনকি সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার কাজেও অংশ নিয়েছিলেন বহু নারী। শুধু তাই নয়- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা, মুক্তির গানের শিল্পীরা গানের মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে জাগিয়ে তুলেছিলেন দেশের ভেতরের অবরুদ্ধ, পীড়িত, নির্যাতিত নারী-পুরুষকে। আজ মুক্তিযোদ্ধাদের জবানি পড়লে বোঝা যায়, নারীদের সাহায্য ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ চালানো দুরূহ হয়ে উঠতো। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা, তার সংগ্রাম তো শুধু প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষভাবেও ছিল। তারা নির্যাতিত, নিগৃহীত হয়েছেন। আবার কখনো মুখ বন্ধ করে তাদের সহ্য করতে হয়েছে স্বজন হারানোর স্মৃতি, যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজ অধিকারের জন্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঠিক যেমনটি ঘটেছিল বাংলাদেশের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ'-এর নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতার জীবনে। সেই রাতের কথা মনে করলে, সবকিছু ছাপিয়ে আজও মেঘনার মনে পড়ে হানাদার বাহিনীর পায়ের শব্দ, গোলা-গুলির ভীতিকর আওয়াজ। মেঘনা গুহঠাকুরতা তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। অধ্যাপক বাবা ও স্কুল শিক্ষিকা মাকে ঘিরে সুখী এক পরিবার। অথচ একাত্তরের মার্চ মাসের সেই কালরাত তাদের জীবনটাকে একেবারে উল্টে-পাল্টে দিল। চিরদিনের মতো পিতৃহারা হলেন মেঘনা মেঘনা বললেন, 'আমার বাবা ছিলেন ইংরেজি ভাষার শিক্ষক। তিনি খাতা দেখছিলেন সেই রাতে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর মা বাড়িতেই অন্য একটা ঘরে ছিলেন। হঠাৎ করে প্রচন্ড গোলা-গুলির শব্দ শোনা গেলে আমায় জাগিয়ে তোলা হয়। এরপরই পাকিস্তানি সেনারা এসে হানা দেয় আমাদের বাড়িতে। ধাক্কা দিয়ে, লাথি দিয়ে দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার উপক্রম করে। বাগান দিয়ে ঢোকে তিনজন সৈনিক এবং এসে তারা বাবাকে নিয়ে যায়। সে সময় যেহেতু শিক্ষকরা একটা অসহযোগ আন্দোলন করছিলেন, তাই আমরা ভেবেছিলাম যে তারা বাবাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। কিন্তু পর মুহূর্তেই আমরা বুঝতে পারলাম। না, অ্যারেস্ট নয়- তারা বাবাকে প্রথমে তার নাম জিজ্ঞাসা করে। বাবা তার নাম বলেন। তারপর তার ধর্ম কী তা জিজ্ঞাসা করে। বাবা বলেন হিন্দু। এরপরই বাবাকে প্রথমে ওরা ঘাড়ে গুলি করে। তারপর দ্বিতীয় গুলিটা করে কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা পড়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভেতরে ভেতরে যেন আরও একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মেঘনা গুহঠাকুরতার পরিবারে। গুলিবিদ্ধ হয়েও বাবা জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কোয়ার্টারে ও ঢাকা মেডিকেলে মৃতু্যর সঙ্গে লড়লেন কয়েক দিন। মারা গেলেন একরকম বিনা চিকিৎসায়। সেদিনের সে কথা মনে করে আজ মেঘনার ভাষ্য, '২৫ মার্চের রাত্রি, ২৬ মার্চের দিন এবং রাত এই পুরো ২৪ ঘণ্টা আমরা বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি। কারণ, সে সময় কার্ফিউ চলছিল। টহলদার বাহিনী সবাই গুলি করছিল। পরে ২৭ তারিখের সকালে কার্ফিউ ভাঙার পর, আমরা রাস্তার কিছু সাধারণ মানুষকে ডেকে বলি বাবাকে উল্টো দিকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তখনও বাবা সচেতন এবং জীবিত। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা জানান, 'ক্রিটিকাল ইঞ্জুরি'-র কারণে আর কিছুই করা সম্ভব নয়।' মেঘনার জীবনে চিরদিনের জন্য এক দাগ থেকে গেল অর্থাৎ একটা ১৫-১৬ বছরের মেয়েকে ২৪ ঘণ্টারও বেশি একটা সময় আহত বাবার হাত ধরে বসে থাকতে হয়েছিল। একটা দেশে একদিকে যখন ভবিষ্যতের ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে ছোট্ট একটা মেয়ের জীবনে চিরদিনের জন্য দাগ কেটে যাচ্ছে সেই ইতিহাসের চরম বাস্তবতা। মেঘনা জানান, 'আমি তখন কান্নাকাটি করছি। মাকে বলছি, মা তুমি দেয়াল টপকিয়ে নার্সদের হোস্টেলে যাও। একজন নার্সকে নিয়ে এসো। বা স্বপ্ন দেখছি, ইস্‌ যদি একটা রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যেতু তাহলে বাবাকে তাদের হাতেই তুলে দিতাম। বাবা সুচিকিৎসা পান, তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তখন সেটাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের তিনজনের মধ্যে একমাত্র বাবাই টের পেয়েছে যে ইতিহাস রচিত হচ্ছে। কারণ আহত অবস্থাতেই বাবা আমার মাকে ধরে বলেছিলেন, লেখো। মা বলছেন, কী লিখব। বাবা বললেন, ইতিহাস। মা তখন বলেছিলেন, আমি যে ইতিহাস লিখতে পারি না। শুনে বাবা বলেছিলেন, তাহলে সাহিত্য লেখো। সেই কথার সূত্রেই ওই ঘটনার প্রায় ২৫ বছর পর, মা একটি বই লিখেছিলেন 'একাত্তরের স্মৃতি'।' সেই ঘটনায় মা বাসন্তী গুহঠাকুরতা হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। সবদিকেই বিপদ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ। ঝুঁকি নিলেন অন্য রকমের। খ্রিস্টান পরিচয় দিয়ে নিজে ভর্তি হলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আর মেয়ে মেঘনাকে রাখলেন ফার্মগেটের একটি অরফানেজে। এভাবেই পুরো নয় মাস বাঁচার জন্য নানা পরিচয়ে নানা জায়গায় যুদ্ধ করতে হয়েছে তাদের। মেঘনার কথায়, 'বাবা মারা যান ৩০ তারিখে। আর তারপরেই আমাদের বেরিয়ে আসতে হয় বাবাকে ওভাবে রেখেই। তখন আর্মি হাসপাতাল আক্রমণ করার ফলে, তার মৃতদেহের সৎকার্য আমরা করতে পারিনি। সেই শুরু। এরপর ঢাকা শহরেই আমরা নয় মাস ছিলাম। বিভিন্ন মানুষের বাসায়, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন রূপ নিয়ে থাকতে হয়েছিল আমাদের। মাঝেমধ্যে পরিচয় গোপন করে থাকতে হয়েছিল, বিশেষ করে আমার মাকে। আমি তখন হলিক্রস স্কুলে পড়তাম। তাই কনভেন্টের বহু সিস্টার আমাদের চিনতেন। তাই তাদের কাছে গিয়েই আশ্রয় চাওয়া হয়েছিল। তারা মাকে বিনা পয়সায় সেখানে আর আমাকে অরফানেজে রাখতে রাজি হন। তবে আমাকে খ্রিস্টান হিসেবে থাকতে হয়েছিল। তখন হিন্দু ছেলেমেয়েদের ওপর এক ধরনের আক্রমণ চলছিল। আর্মিরা এসে রেজিস্টারে রোল চেক করত- কে হিন্দু, আর কে মুসলমান। তারপর বেছে বেছে নিয়ে যেত হিন্দুদের। বাবার মৃতু্য প্রমাণিত করতেই দেশে থেকে গেলেন মেঘনা কিন্তু কেন। কেন তারা চলে গেলেন না দেশ ছেড়ে। মেঘনা গুহঠাকুরতা জানান, 'আমার মার স্থির বিশ্বাস ছিল যে আমরা যদি অন্যদের মতো ভারতে চলে যাই, তাহলে বাবার এই মৃতু্য প্রমাণিত হবে না। কারণ, মা যখন পরে হাসপাতালে বাবার 'ডেথ সার্টিফিকেট নিতে যান, তখন দেখেন যে তাতে লেখা আছে- 'ডেথ বাই নিউমোনিয়া'। প্রথমে কিন্তু বেডের ওপর 'ডেথ বাই বুলেট ইঞ্জুরি' লেখা ছিল। মা যখন এ ব্যাপারে ডাক্তারদের প্রশ্ন করেন, ডাক্তাররা বলেন যে, 'সত্য কথাটা আমরা এখন বলতে পারব না। এখন আপনাকে এই ডেথ সার্টিফিকেটই নিতে হবে'। মা তখন আমায় বললেন, দ্যাখ, এই মৃতু্য যাতে প্রমাণিত হয় এর জন্য আমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে। ইট ইস ডেথ বাই বুলেট ইঞ্জুরি। ইট ইস অ্যান এক্সিকিউশন। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মতো অসংখ্য মানুষকে হত্যা, বহু মানুষের ত্যাগ আর অদম্য আত্মবিশ্বাসের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সফল হয়েছে অচিরেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেদিনের সেই সত্তাকে আমরা কি সত্যিই ধরে রাখতে পেরেছি। সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞের পরও কিন্তু আশাবাদী আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক মেঘনা গুহঠাকুরতা। তার কথায়, 'মুক্তিযুদ্ধকে আমি মনে করি 'ফাউন্ডেশনাল'। ওই ঘটনা-পরবর্তী জীবনে আমি শিক্ষক। আমি ২২ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। আমি আমার ছাত্রদের বুঝিয়েছি যে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পরিচিতি দিয়েছে। বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি যে, আমাদের নতুন প্রজন্ম সে কথা ভোলেনি।