বিশ্ব বিবেককে ধাক্কা দেয়া

অপারেশন হোটেল আগ্রাবাদ

প্রকাশ | ১৮ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

মর্জিনা আখতার
পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলে দুনিয়াজুড়ে অপবাদ দিচ্ছিল। বিশ্ব বিবেককে বিভ্রান্ত করার জন্য ঘাতক পাকিস্তানি সরকার জাতিসংঘসহ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সামনে বলছে, পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ চলছে না। চলছে দুষ্কৃতকারীদের নাশকতা, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা খুবই স্বাভাবিক। সীমান্ত এলাকায় টুকটাক গুলি করে দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে চলে যাচ্ছে ভারতে। শহর বন্দরের অবস্থা পরিপূর্ণ স্বাভাবিক। পাকিস্তান সরকারের এই দাবির পক্ষে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বড় একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছে জাতিসংঘ। এই তথ্য পেয়ে গেলেন চট্টগ্রাম এবং রণাঙ্গনের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা। তারা চট্টগ্রামে অবস্থানরত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের এই সংবাদ পাঠালেন হোটেল আগ্রাবাদ অপারেশন সম্পন্ন করার জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিজ্ঞা করলেন জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলকে বুঝিয়ে দেবেন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক নয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা দুষ্কৃতকারী নয়। তারা দেশপ্রেমিক বাঙালি গেরিলা যোদ্ধা। এই প্রতিজ্ঞার ভিত্তিতে দলনেতা ডা. মাহফুজুর রহমান প্রয়োজনীয়সংখ্যক গেরিলা যোদ্ধার তালিকা তৈরি করে প্রণয়ন করলেন পরিকল্পনা। গেরিলা যোদ্ধারা হলেন ডা. জাফর উলস্নাহ বোরহান, ডা. সাইফুদ্দিন, ফয়েজুর রহমান, গরিব উলস্নাহ, সফিক আহমেদ মুন্সী। কঠিন গোপনীয়তার সঙ্গে কমান্ডার জেনে নিলেন হোটেল আগ্রাবাদের অবস্থান এবং জাতিসংঘ বাহিনী কোন কোন কক্ষে অবস্থান করছে সবই জেনে নিলেন। শুরু হলো রেকি পর্ব। সময় বেশি নেই। হাতে মাত্র দুদিন সময়। যেহেতু গরীব উলস্নাহ এলাকার ছেলে। সে বিস্তারিত জানে এলাকা সম্বন্ধে। একবার হকার হিসেবে, বিদু্যৎ বিভাগের কর্মচারী হিসেবে গরীব উলস্নাহ মুন্সী প্রবেশ করলেন হোটেলের অভ্যন্তরে। আবার ফয়েজুর রহমান মৌলভীর ছদ্মবেশে বাইর দিয়ে ঘুরে এসেছেন। এদের রেকির রিপোর্ট হলো হোটেল আগ্রাবাদটা মূলত, সেনাবাহিনীর পুরো নিয়ন্ত্রণে। কোনোভাবেই ভেতরে ঢুকে অপারেশন সম্পন্ন করা যাবে না। মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন সবাই। সময় শেষ প্রায়। হাতে মাত্র আর একটি দিন। এরি মধ্যে মুন্সী, গরীব উলস্নাহ খবর দিলেন হোটেল আগ্রাবাদের পূর্ব উত্তর কোণের বিশেষ একটি অংশে রয়েছে বিদু্যতের বিশাল ট্রান্সফরমার, কমান্ডার দেখে এলেন। এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আঘাত করতে হবে এখানেই। স্থানটি অন্ধকারাচ্ছন্ন, পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান নেই, রাজাকার বাহিনী পালা করে এইখানে পাহারায় থাকে। দলনেতা অতিদ্রম্নততায় সংগ্রহ করলেন প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক ও অস্ত্র। বসলেন মোগলটুলীর কবির তোরণ মাতব্বর বাড়িতে। বাড়ির প্রবেশ পথের দু'পাশে কবরস্থান। এই বাড়ির মহিলা হাজেরা খাতুন ও হাফিজা খাতুন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। গেরিলা যোদ্ধাদের মা ও ভাবী। সেদিন ছিল ২ রমজান। এলাকাবাসী তখন মসজিদে চলে গেছেন তারাবির নামাজ পড়তে। রাস্তায় মানুষের চলাচল খুবই কম। ঠিক এ সময় মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা কবির তোরণের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পড়েছেন কাঙ্ক্ষিত অপারেশন স্থানের দিকে। দ্রম্নত চলে এলেন ট্রান্সফরমার গেটে। নিরাপত্তা প্রহরীরা তখন গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। দেয়াল টপকে গেরিলা যোদ্ধারা লাফিয়ে পড়লেন প্রহরীদের চোখের সামনে। চোখের পলকে বুঝে অস্ত্র ঠেকিয়ে বললেন, চুপ থাকতে না হয় গুলি। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা বিহ্বল। কোনো কথা বের হলো না তাদের। গেট খুলে তাদের নিয়ে আসা হলো বাইরে নিরাপদ স্থানে। ডা. জাফর উলস্নাহ বোরহান ও ডা. সাইফুদ্দিন অস্ত্র ধরে দাঁড়িয়ে। গরীব উলস্নাহ, ফয়েজুর রহমান চলে গেলেন ট্রান্সফরমারের সামনে। বিস্ফোরক স্থাপন করলেন খুব দ্রম্নত সময়। সফিক আহমেদ মুন্সী ছিলেন বাইরে পাহারায়। পাহারাদারদের অস্ত্রগুলো নিয়ে মুন্সী অন্ধকারে ছিলেন কভারিং-এ। বিস্ফোরক বসানো শেষ। গেরিলা যোদ্ধাদের মায়া হলো রাজারকারগুলোর প্রতি। তাদের আরও নিরাপদ স্থানে এনে বেঁধে রাখা হয়েছে। যেন ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ ঘটলে তারা যেন বেঁচে যায়। বিস্ফোরক সঠিক স্থানে বসিয়ে কিছুটা দূরে টেনে এনেছে কর্ভ দুটি, আগুন ধরিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। ওই রাজাকার প্রহরীরা মনে করেছিল গেরিলারা পেছনে অস্ত্র তাক করে রয়েছে। সেজন্য তারা চিৎকার দেয়নি। তারা বারবার বলছিল যেন তাদের হত্যা করা না হয়। সময় মাত্র ১৫ মিনিট। বিস্ফোরক বসিয়ে, কর্ভে আগুন দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ততক্ষণে চলে এসেছেন নিরাপদ স্থানে। সময় রাত ৯টা বেজে ১২ মিনিট। প্রচন্ড শব্দে পর পর দুটি আওয়াজ হলো। প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটল। পুরো হোটেল আগ্রাবাদ কেঁপে উঠল, দেয়াল ধসে পড়ল। অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো হোটেল আগ্রাবাদের প্রতিটি কক্ষ। বাইরে এবং ভেতরে প্রচন্ড চেঁচামেচি। প্রতিটি কক্ষ থেকে মরণ চিৎকার। বাইরে পাহারারত পাকিস্তানি ঘাতক সৈন্যরা অন্ধকারে আকাশের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করল। টর্চ লাইটের আলো জ্বেলে প্রতিজন বোর্ডার এবং জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল নেমে এলেন রাস্তায়। এরই মধ্যে চলে এসেছে সেনাবাহিনীর অসংখ্য গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স। প্রায় দু'ঘণ্টা পর পাশের বিল্ডিং থেকে আলোর ব্যবস্থা করে এলাকাকে আলোকিত করেছে। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় কর্মী, আমি তখন মসজিদে ছিলাম। নামাজ তখন ১০ কি ১২ রাকাত শেষ হয়েছে। প্রচন্ড আওয়াজের শব্দ। বুঝতে পারিনি। পুরো এলাকাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য আওয়াজ শুনেছি তবে এত প্রচন্ড আওয়াজ শুনিনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েব অব আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এই অপারেশনের বীরত্বপূর্ণ কথাগুলো প্রচার করেছে। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল বুঝতে পেরেছে এখানে গেরিলা যুদ্ধ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে, কোনো মানুষকে হত্যা না করেই মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্ব কাঁপানো অপারেশন সম্পন্ন করেছে। তারা প্রমাণ করেছে এটাই মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি ঘাতকরা অসহায় বাঙালিদের হত্যা করছে আর বাঙালি যোদ্ধারা মানুষ হত্যা না করেই দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছে। মুক্তিযোদ্ধারা দুষ্কৃতকারী নয় তারা দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। বড় মাপের এই অপারেশন সম্পন্ন করার আগে মুক্তিযোদ্ধারা সময় পেয়েছিলাম মাত্র দুদিন। এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নির্বাচন করেছেন গেরিলা যোদ্ধাদের, বিস্ফোরক ও অস্ত্র তৈরি করেছেন। প্রয়োজনীয় রেকি সম্পন্ন করেছেন। অপারেশন সময় ছিল মাত্র ৩০ মিনিট। ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরক বসিয়ে এবং কর্ডে আগুন ধরিয়ে আবার ফিরছে নিরাপদ আশ্রয়ে। বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল রমজানের পবিত্র এই সময়ে গেরিলা যোদ্ধারা কাউকে হত্যা করেনি। অপারেশন স্থল থেকে আশ্রয় কেন্দ্রের দূরত্ব খুবই অল্প। অপারেশনের কমান্ডার থেকে শুরু করে প্রতিজন গেরিলা যোদ্ধারা চলে গেছেন দূরে অন্য আশ্রয় কেন্দ্রে। এই অপারেশনটি ছিল বুদ্ধির খেলা। অস্ত্রধারী অনেকজন পাকিস্তানি সৈন্যকে ফাঁকি দিয়ে এতবড় অপারেশন শুধুই দেশপ্রেমিক গেরিলা যোদ্ধাদের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল। এলাকাবাসী ভয় পেলেও আনন্দিত হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এলাকার ছেলে ছিলেন গরীব উলস্নাহ এবং সফিক আহমেদ মুন্সী। অপারেশনের পর থেকেই দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত পুরো হোটেল আগ্রাবাদ এলাকা ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ঘেরাও। অপারেশনের পর থেকে হোটেল আগ্রাবাদে আর কোনো বোর্ডার বা গ্রাহক আসেনি। এই অপারেশনের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ বুঝে গেছেন দেশটা স্বাধীন হবেই। তথ্যসূত্র : ডা. মাহফুজুর রহমান, ১৯৭১-এ শহর চট্টগ্রামের অপারেশন কমান্ডার। আবদুল মতিন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতন কেন্দ্র ডালিম হোটেল থেকে ফিরে আসা ছাত্র। সাখাওয়াত হোসেন মজনু, গ্রন্থ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক। সফিক আহমদ মুন্সী, এই অপারেশনের অন্যতম গেরিলা যোদ্ধা। লেখক : কবি, শিক্ষাবিদ ও গবেষক