নারীর সাবলীল অগ্রযাত্রা

প্রকাশ | ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সুলতানা শিকদার অহনা
এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যাচ্ছে নারী। দেশের উন্নয়ন পরিধি বাড়াতে নিজ নিজ কর্মস্থলে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে এ যুগের নারীরা। বিশেষ করে কাপোরেট জগতের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। করপোরেট জগতের বিভিন্ন উচ্চপদের জায়গায় নারীরা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। যার ফলে, করপোরেট সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় অনেক আসন আজ নারীদের দখলে। যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই এ আসনে আসীন হয়েছে নারী। নিঃসন্দেহে একটি জাতির জন্য ইতিবাচক দিক। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বাস্তবিকই কার্যকর অগ্রগতি হয়েছে- তার স্বীকৃতি এখন পাওয়া যাচ্ছে। তবুও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, একজন করপোরেট নারীর কী কী গুণাবলি থাকা উচিত? কীভাবে তিনি তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারেন? পুরুষশাসিত কর্মযজ্ঞে নারীর জন্য কর্মপরিবেশ কি আদৌ তার জন্য পর্যাপ্ত? কিংবা, কীভাবে একজন করপোরেট নারী ইতিবাচক মনোভাব ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে নিয়ন্ত্রিত ও কর্মবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলায় মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন? আমরা সবাই জানি, একটি চাকরির জন্য যথার্থ যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয়। করপোরেট পরিবেশে যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য নারীদের বিশেষভাবে প্রচেষ্টা করতে হয়। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতার পরিমাপক কর্মক্ষমতা-নির্দিষ্ট। সুতরাং, তারা প্রত্যয়ের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। নারীদের কিছু গুণ আছে- যা তাদের সব রকম উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে। নারীরা সহানুভূতিশীল এবং তারা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। তাদের ভাবের আদান-প্রদান রীতি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তারা কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই সব সময় প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। তারা মতামত, পরামর্শ এবং সাহায্য গ্রহণের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকেন। তাদের সতর্ক থাকারও একটি প্রবণতা আছে। তারা বোঝার জন্য এবং শেখার জন্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। তারা মানুষের দুর্বলতাগুলোর চেয়ে সামর্থ্যকে বেশি বড় করে দেখেন। তারা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও বেশ সময় নিয়ে চিন্তা করেন এবং যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করার গুণাবলি রাখেন। কিন্তু পুরুষশাসিত শিল্পে নারী হয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করা বা কাজ করা কখনো কখনো বেশ কঠিন একটি বিষয়। সমস্যা থাকতেই পারে তবে সনাতন সাংস্কৃতিক বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। নারী তাদের বাড়িতে নিজেদের ন্যায্য অবস্থানকে দৃঢ় করার জন্য হতে হবে আরও স্পষ্টভাষী। বর্তমান বাংলাদেশে আরও বহুসংখ্যক নারী করপোরেট পদগুলোতে অবস্থান করতে পারেন এবং এটি সম্ভব হতো না যদি কিনা পরিবার এবং সমাজের মধ্যে যথাযথ বোঝাপড়া না থাকে। সুতরাং, সমান অধিকার নিয়ে বিতর্ক করার পরিবর্তে নারীরা তাদের নিজেদের জীবনের হাল ধরার সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে এবং তাদের যোগ্যতা দিয়ে তাদের প্রাপ্য অর্জন করে নিতে হবে। মেয়েদের কর্মপরিবেশ নিয়ে বলতে গেলে আসলে বলতেই হয়- তারপরেও মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং উন্নতি যতটা আশা করা হয় আমরা তার কাছাকাছিও এখনো যেতে পারিনি, এখনো অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার বাকি। তবে যাত্রা যখন শুরু হয়েছে সাফল্যও চলে আসবে। আমরা যদি কিছু বিষয় সমাধা করার মতো মানসিক ইচ্ছা ও বুদ্ধি রাখি তাহলে মেয়েদের চলার পথ অনেকখানি সাবলীল হবে এবং অগ্রযাত্রার পথেও আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হবে। যে বিষয়গুলোতে আমাদের মেয়েদের মনোযোগ দিতে হবে সেটা নিয়ে একটু বলি- খুব নতুন কিছু না, কর্মজীবনের কম-বেশি সব মেয়েকেই কিন্তু হয়রানির শিকার হতে হয়। আমরা সবাই স্পষ্টতই জানি যে, কর্মস্থলে হয়রানি বিদ্যমান কিন্তু যখন এটি নিজের সঙ্গে বা অন্যের সঙ্গে ঘটে তখনি হয় বিপত্তি, বিশেষ করে যদি আপনি কর্মশালায় নতুন হন। এটি অত্যন্ত বিরক্তিকর তো বটেই, আবার উপযুক্ত পদ্ধতিতে প্রতিক্রিয়া করা ও কঠিন। কম অভিজ্ঞতা আরও আতঙ্কজনক। এটি একটি মেয়ের মনের ওপর গভীরভাবে চাপ তৈরি করে। মেয়েটি কোনো প্রতিকার করতে না পেরে হতাশ হয়ে যায়; অনেক সময় নানান ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে- যা সুখকর নয়। তবে ভালো খবর হলো, এখন মানুষ অনেক সচেতন, কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে যাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে এবং মেয়েরা নিচিন্তে কাজ করে ঘর বাইরে দুটিই সামলিয়ে চলতে পারে। আমি এ বিষয়ে পারদর্শী না, কিন্তু আমি আমার কর্মজীবন থেকে যতটুকু শিখেছি সেটাই বলতে চাই- বিশেষ করে যারা এখন চাকরিতে নতুন বা চাকরি খুঁজছে তাদের। প্রথম কথা, যে লোকটি তোমাকেই হেনস্তা করছে তাকে ব্যাপারটা বুঝতে দিতে হবে, পরিষ্কার করে বলতে হবে, সে যেটা করছে ব্যাপারটা আপনার পছন্দ না, তাকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া যদি সে এটি বন্ধ না করে তাহলে আপনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে বাধ্য হবেন। সাধারণত সাহস করে মুখের উপরে বলতে পারলে এতে কাজ হয়। অনেক সময় যে কাজটি করছিল সে বুঝতে পারে না, সে আসলে আরেকজনের বিরক্তির কারণ হচ্ছিল। তারপরে যদি আপনি বিষয়টা রিপোর্ট আকারে তুলতে চান তাহলে সবকিছু গুছিয়ে লিখে রাখা ভালো বলে আমি মনে করি। যদি সেটাও কাজ না করে তাহলে আমি বলব ওরকম জায়গাতে কাজ না করাই ভালো। সিদ্ধান্তটা যদিও কঠিন, কিন্তু কর্মজীবনে সাফল্য এবং শান্তি পাওয়ার জন্য এটাই সঠিক। যদি শান্তি আর সাফল্য না আসে তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আর যাই হোক একজন নারী সফল নারী হতে পারবে না। তাই এই বিষয়টা গুরুত্ব দেওয়া খুব জরুরি। যাতে একটি মেয়ে কাজ শুরু করেই আবার শেষ না করে দেয়। আমি এও দেখেছি অনেক পুরুষ সহকর্মী মেয়েদের কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তারা কর্মস্থলে মেয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে সহনশীল এবং সাহায্যকারীর ভূমিকা হিসেবে কাজ করে। আমি আমার অনেক পুরুষ সহকর্মীকে দেখেছি যারা নারী সহকারীদের হেনস্তা একদম সহ্য করে না। আমি অনেক মেন্টর পেয়েছি যারা আমার কাজের গঠনগত সমালোচনা করেছে এবং কর্মস্থলে আমার দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। এ রকম পুরুষ সহকর্মীর সংখ্যা কিন্তু নেহাতই কম না। তাই একেবারে আশাহত হওয়ারও আমি কোনো কারণ দেখি না। আমি কর্মপরিবেশে মানসিক এবং শারীরিকভাবে হেনস্তা হওয়ার কথা শুরুতে এই জন্য বললাম যে, আমাদের দেশে এখনো অনেক মেয়ে এই কারণে চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে থাকে, তারা বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে এই বিষয়ে লড়বে। যখন তারা এই ব্যাপারটা ডিল করতে শিখবে বাকি পথটা অনেকটাই মসৃণ হবে- তাতে সন্দেহ নেই। যাই হোক, আবার আসল কথাতে আসি। কীভাবে একজন মেয়ে হিসেবে এই পুরুষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিজেকে একজন অপরিহার্য অংশ হিসেবে দাঁড় করবে? আমি নিজেকে সব সময়ই একটা কথা বলি- সেটা হলো অনেকের মধ্যে একজন হওয়ার থেকে কিছু না হওয়া ভালো। তার চেয়ে যে কোনো একটা বিষয় মনোযোগ দেওয়া ভালো। নিজেকে মূল্যবান করে গড়ে তোলা খুব জরুরি। যাতে আপনি একজন কর্মদক্ষ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমি দেখেছি এবং করেছি সেটা হলো মিটিংয়ে কোনো কথা না বলা, এটা অনেকটা নিজের ফাঁদে নিজে পড়া। মেয়েদের শুধু কথা বলা উচিতই নয় বরং অনেক বেশি ঘটনমূলক এবং দ্বিধাহীন স্পষ্ট হওয়া উচিত। আপনি ওই মিটিংয়ে বসেছেন কোনো একটি ভালো কারণে, সেটা বিশ্বাস করতে শিখতে হবে। ছোট করে সুন্দর করে নিজের মতামত প্রকাশে কোনো ক্ষতি নেই। মাফ করবেন, যদি আপনারা এটাতে একমত না হন, এ জাতীয় কথা বললে আপনার মতামত তার গুণগত মান হারাবে। নিজের মতামত প্রকাশে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আরও একটি ঝামেলা যেটা সব সমই হয়- সেটা হলো নারী সহকর্মী কথা বা মতামত দেওয়া শুরু করলেই অন্য একজন পুরুষ সহকর্মী তাকে বাধা দিতে শুরু করে, তার কথার মাঝখানে কথা বলা শুরু করে। বা এমন যে তুমি কেন কথা বলছ। আমার সঙ্গে অনেকবার এটা হয়েছে। এটাও শুনতে হয়েছে তুমি এত বেশি বোঝো কেন? এ রকম সময় কথা বলা বন্ধ না করে বিনয়ের সঙ্গে সেই সহকর্মীকে বলা, আমি আমার কথা এখনো শেষ করিনি, অথবা আরও ভোকাল হয়ে যাওয়া; কিন্তু রাগ করা যাবে না কিছুতেই। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে মূল বিষয়গুলো ঘটনমূলকভাবে তুলে ধরতে হবে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে আপনি শক্তি প্রদর্শন করবেন, কিন্তু রাগ বা উত্তেজিত হয়ে নয়। অনেক পুরুষ সহকর্মী সেটাই চায় আপনার কাছ থেকে, যেন আপনি লজ্জা পেয়ে, রেগে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তারপর হলো- নিজের কাজের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোতে দখল নেওয়া। নিজের শিক্ষা এবং কাজের পরিধিকে যতটা পারা যায় ঝালিয়ে নিতে হবে প্রতিদিন। নিজের দুর্বলতাকে লুকিয়ে না রেখে সেটা কাটানোর চেষ্টা করতে হবে, নিজের মানসিক এবং প্রোফেশনাল উন্নতির চেষ্টা সব সময়ই থাকতে হবে। এটা যেমন সত্যি সফলতা দাবি করে অদম্য ইচ্ছাশক্তি, প্রতিনিয়ত নিজের উন্নতি ইচ্ছে, তেমনি এটাও সত্যি আমরা মানসিকভাবে পদমর্যাদা খুঁজতে থাকি, ভাবী ওই পদমর্যাদা পেলে আমার সবকিছু সহজ হবে। একটি আরামদায়ক জায়গাতে যেতে পারলে অধিকাংশ মেয়েই হাল ছেড়ে দেয়। নতুন কিছু শেখার বা করার আর চেষ্টা করে না, বিপত্তি তখনই হয়- মেয়েদের ওই টপ স্থানগুলোতে তখন আর চিন্তা করা হয় না। প্রতিষ্ঠানে কারা প্রতিনিয়ত সামনের সারিতে থাকছে, চ্যালেঞ্জে নিচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজের আরামের জায়গা থেকে বের হয়ে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার মতো সৎসাহস থাকতে হবে। পরিবর্তন এবং ইতিবাচক মনোভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তন প্রতি ইতিবাচক মনোভাব থাকার ওপর নির্ভর করে একটি পুরুষ ডোমিনেটেড সেক্টরে আপনি কতটা সফল হবেন। আপনার সহকর্মী এবং আপনার বস বা সুপারভাইজর যদি আপনাকে নতুন চ্যালেঞ্জ এবং কঠিন নিয়োগের পাশাপাশি সমস্যা সমাধান করার বিষয়েও চেনেন তবে তারা আপনার সঙ্গে তথ্য ভাগ করে নেওয়ার এবং তাদের দলের অংশ হিসেবে আপনাকে সংযুক্ত করার কথা চিন্তা করবেন। মেয়েদের নেটওয়ার্কিংয়ের শক্তি কম, বা তারা নেটওয়ার্কিং করতে চায় না। জড়তা বোধ করে, ভাবে আমি মেয়ে আমি কেন আগ বাড়িয়ে কথা বলব? কিন্তু নেটওয়ার্কিং মিটিং আপনি একজন কর্মী বা প্রোফেশনাল, আপনি মেয়ে বা ছেলে সেটা মোটেও গুরুত্ব পাওয়া উচিত নয়। আর কাজে সফলতা পেতে হলে নেটওয়ার্কিং ও ভালো হওয়াটা বাধ্যতামূলক। শক্তিশালী যোগাযোগের মাধ্যমে আপনি আপনার সংস্থায় নতুন ব্যবসা আনতে যেমন পারবেন, তেমন আপনার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে। কর্মপ্রতিষ্ঠানে নিজের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অর্জন হতে তখন আর বেশি সময় লাগবে না। আপনি তখন ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য একজন মূল্যবান মানবসম্পদে পরিণত হবেন। আপনি মেয়ে বা ছেলে সেটা আর মুখ্য বিষয় হবে না। একটি শক্তিশালী পেশাদার নেটওয়ার্ক তৈরি করে আপনিও প্রতিস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে পারবেন এবং আপনার সাফল্য তখন নেহাতই সময় মাত্র।