নারীর স্বপ্ন পূরণ

প্রকাশ | ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

মাসুদ হোসেন
মাধ্যমিকের গন্ডি না পেরোতেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। কিন্তু অদম্য মানসিকতা যার, তিনি এখানেই থেমে যাবেন, তা কি হয়! সংসার-সন্তান সামলে চুকিয়েছেন পড়াশোনার পাঠও। চাকরি নয়, ব্যবসা করবেন, স্বাবলম্বী হবেন। তাই স্বামীর দেওয়া হাতখরচের টাকা জমিয়ে স্বল্প পুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও বেড়েছে তার কলেবর। পরিবারের ৬ ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম ইয়াসমিন। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা চাঁদপুরে। ২০০৯ সালে চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহতলী জিলানী চিশতি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। স্বামীর চাকরি সূত্রে বর্তমানে ঢাকার সাভারে বসবাস। স্বামী-সংসার সামলে দেশীয় পণ্যের একজন ই-কমার্স উদ্যোক্তা ইয়াসমিন। শুধু মনের জোর আর সদিচ্ছার কারণে একজন শূন্য থেকে শুরু করে নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে কীভাবে নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করা যায়, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অদম্য সংগ্রামী ইয়াসমিন। পথটা সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। সেই গল্প জানতে যেতে হবে পেছনে। ইয়াসমিনের শৈশব ও কৈশোরের স্বর্ণালি দিনগুলো কাটে চাঁদপুরেই। স্কুল-কলেজ জীবন, সবকিছুই ছিল রঙিন। কলেজ ক্যাম্পাস, পড়ালেখা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, মুক্তপাখির মতো ঘুরে বেড়ানো- সবকিছুই চলছিল স্বাভাবিক নিয়মে। হঠাৎ করেই বদলে গেল জীবনের দৃশ্যপট। তখন সবেমাত্র উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষে পা রাখেন। পারিবারিকভাবে হঠাৎ করে তাকে দেওয়া হলো বিয়ে। শুরু হলো নতুন জীবন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সহযোগিতায় বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে পাস করেন এইচএসসি। এর পরই জন্ম নেয় একটি কন্যাসন্তান। বিয়ের পর সবকিছু তার কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। নিজের পড়ালেখার স্বপ্ন, স্বামী-সংসার, সন্তানের সেবাযত্ন কীভাবে কী করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান ইয়াসমিন। এক বছর বিরতি দিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়ে আরও দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। পড়ালেখা করে চাকরি পাওয়া যেন সোনার হরিণ। পেলেও স্বামী-সংসার ও মেয়েকে সামাল দেওয়ার কেউ থাকবে না। এমনটা ভেবেই অন্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা মাথায় আসে তার। স্বামীর দেওয়া হাতখরচের সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে শুরু করেন দেশীয় পণ্যের অনলাইন ব্যবসা। শুরুতেই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কুমিলস্নার বিখ্যাত মোমবাটিক পোশাক নিয়ে ২০১৯ সালে কাজ শুরু করেন এই নারী উদ্যোক্তা। কিন্তু এর মধ্যে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চলে আসে মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। তাই কোভিড চলে আসায় সব কাজ থমকে যায় ইয়াসমিনের। ২০২০ সালে ঘরবন্দি অবস্থায় ৩ মাসের সন্তান নিয়েও সাহস করে ফেসবুক পেজ খুলে শুরু করেন ই-কমার্স ব্যবসা। ইয়াসমিন বলেন, 'বাটিক নিয়ে একটা সময় আমার ধারণা ছিল কম দামি সস্তা পোশাক। কিন্তু একটা ভালো মানের বাটিক ব্যবহারের পর আমার সেই ভুল ভাঙে। তখনই মাথায় আসে অন্যদের যেই ভুল ধারণা সেটাকে বদলাতে হবে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এ পণ্যকে নতুন করে পরিচিত করাতে হবে সবার কাছে। সেই চিন্তা থেকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা। কোয়ালিটি ফার্স্ট। আর সেটার সঙ্গে কখনোই আপস করিনি। তাই নিত্যনতুন ক্রেতার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য রিপিট ক্রেতাও পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। তবে শুরু থেকেই আমার স্বামী ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। সময়-সুযোগ করে নানা কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।' নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত অনলাইন ও অফলাইনের প্রশিক্ষণ নেওয়া এ উদ্যোক্তা ২০২৩ সালে ইউএনডিপি ও আনন্দমেলার অধীনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের স্মার্ট নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আইসিটি গ্র্যান্ড ৫০ হাজার টাকার পুরস্কার গ্রহণ করেন। ইয়াসমিন বলেন, 'বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের অনলাইন ও অফলাইন প্রশিক্ষণে যুক্ত করে নিজেকে দক্ষ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি শুরু থেকেই। বর্তমানে অনলাইনে চললেও স্বপ্ন দেখি একদিন আমার উদ্যোগ অফলাইনেও প্রকাশ পাবে। মাত্র ৩৫০০ টাকায় শুরু করা বিজনেসটাকে ৪ বছরে যেটুকু এনেছি তার জন্য এখনো কোনো ঋণ করতে হয়নি। যেহেতু বিজনেসটা অনলাইনভিত্তিক তাই নারী হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। নারীদের যে সম্মানের জায়গাটা সেটা আমাদের সমাজে এখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।' ইয়াসমিনের পণ্য দেশের ৬৪ জেলার পাশাপাশি বর্তমানে দেশের গন্ডি পেরিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ ইউরোপ-আমেরিকার ১৬টি দেশে পৌঁছে গেছে। একজন নারী উদ্যোক্তার হাত ধরে আসা রেমিট্যান্স সত্যিই আনন্দদায়ক। বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা যেখানে নারী সেখানে নারীকে বাদ দিয়ে এ পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও কথাটি পুরোপুরি সত্য। বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের সূচনালগ্নে তারা নানা খাতে দেশ ও দেশের বাইরে কাজ করে সাফল্য বয়ে আনছেন। দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন বেসিসের ১ হাজার ৩০০টির বেশি সদস্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০টির শেয়ার ও পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আরেক বড় অগ্রগতি এনেছে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত করা। এছাড়া ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাত দেশে প্রসারিত হচ্ছে। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। বেসরকারি সমীক্ষা বলছে, দেশে ৩ কোটি ৫৮ লাখেরও বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। গড়ে উঠেছে এফ-কমার্স বা ফেসবুকভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসা। প্রযুক্তিখাতে নারীদের অগ্রযাত্রায় কাজ করছেন 'একবাজ' স্টার্টআপের অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা জোবায়েদা সুলতানা। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে কাজ শুরু করেছেন বাংলাদেশের আইটি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে। প্রযুক্তিকে আপন করে নিয়ে শুরু করেছেন নিজের ব্যবসা। দেশের অন্যতম অ্যাম্বেডেড ফাইন্যান্সিং এবং এবহ-অও ক্ষমতায়িত বিটুবি মার্কেটপেস্নস 'একবাজ'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর তিনি। প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই ওয়েব এবং মোবাইল অ্যাপিস্নকেশনের মাধ্যমে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মুদি দোকানদারদের ব্যবসা ডিজিটালাইজড করে তাদের ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সহজ সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে একবাজের সঙ্গে প্রায় ১ লাখ মুদি দোকানদার, তাদের ব্যবসার উন্নয়নে কাজ করছে। যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক নারীও আছে। জোবায়েদা সুলতানা ২০০৫ সালে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে মার্কেটিং-এ স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তবে তার কর্মজীবন শুরু হয় স্নাতকে পড়ালেখা করা অবস্থায়। ২০০৩ সালে তিনি 'ইন্টারটেক' নামে একটি বহুজাতিক পরিষেবা সিস্টেম কোম্পানিতে কাস্টমার সার্ভিস এক্সিকিউটিভ পদে যোগদান করেন। পরে একই প্রতিষ্ঠানে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে সেলস ম্যানেজার পদে ১২ বছর সুনামের সঙ্গে কাজ করেন। এরপর তিনি চলে যান সিঙ্গাপুরে। ২ বছর কাজ করেন সিঙ্গাপুরের একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে। আর এ ২ বছর তার জীবনের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সিঙ্গাপুরে থেকে গেলে তিনি হয়তো আরও অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পেতেন। তার ক্যারিয়ার হয়তো আরও প্রশস্ত হতে পারত। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে এলেন। বলে রাখা ভালো একবাজ, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি অ্যাম্বেডেড ফাইন্যান্সিং এবহ-অও ক্ষমতায়িত বিটুবি মার্কেটপেস্নস। এটি ওয়েব এবং মোবাইল অ্যাপিস্নকেশনের মাধ্যমে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মুদি দোকানদারদের ব্যবসা ডিজিটালাইজড করে তাদের ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সহজ সমাধানে কাজ করছে। সবার একান্ত প্রয়াসে, একবাজ দ্রম্নত সময়ে আন্তর্জাতিক স্টার্টআপে পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামেও রয়েছে এর কাজের পরিধি। জোবায়েদা বলেন, 'চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের এ যুগে নারী-পুরুষের কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষায় যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট দক্ষতা বিভেদ নেই, সেহেতু নারী-পুরুষ উভয়ে সমভাবে তাদের কর্মদক্ষতা অর্জন করে নিজেদের আরও বেশি পেশাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। শহর, বন্দর ও গ্রামে নারীদের প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা তথা আইসিটি ও স্টিমভিত্তিক শিক্ষায় এগিয়ে দিতে তাদের প্রযুক্তিবিষয়ক সব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে আমাদের তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।'