কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে থাকতে হবে সময় পরিকল্পনাও

কলকাতাভিত্তিক ম্যাগাজিন সানন্দার সদ্য সাবেক সম্পাদক শর্মিলা বসুঠাকুর। দিন কতক আগে তিনি তার ১৫ বছরের চেনা পরিবেশ সানন্দার সম্পাদকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। সম্প্রতি একটি রান্নার প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে ঢাকায় এসেছেন। পৈতৃক ভিটের টানে ছুটে গেছেন ঠাকুরদাদার গ্রাম বিক্রমপুর। ঢাকা থাকাকালীন নন্দিনীর সঙ্গে তার এক সাক্ষাৎকারে উঠে আসে নারী জীবনের সুখ দুঃখ, কর্মক্ষেত্র, কর্মপরিকল্পনা ও দর্শনতত্ত্বের নানা বিষয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাহমিনা সানি

প্রকাশ | ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
শর্মিলা বসুঠাকুর
ষ প্রকৃতি শান্ত, কোমল, গতিময়। নারীও তাই। বলা হয়ে থাকে, সৃষ্টি সৌন্দর্য ও কল্যাণ- নারীর মধ্যেও আছে এই তিনের সমন্বয়- যা কি না প্রকৃতিরও মূল শক্তি। আপনার দৃষ্টিতে নারী ও প্রকৃতি কেমন? ষ দর্শনের ছাত্রী ছিলাম। সাংখ্য দর্শন নিয়ে আমি পড়াশুনা করেছি। সাংখ্য দর্শনের একটা তত্ত্বই আছে- পুরুষ ও প্রকৃতি। আমার কাছে প্রকৃতি নারী। তার ধারণ শক্তি আছে। সে কোমল। সতেজ। আশ্রয়দাত্রী এবং শক্তির আধার। ষ এখনকার নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মক্ষেত্রে সচল এবং সফল। কিন্তু ঘুরে ফিরে সংসারের চাকায় তাদের মননটা চরকি খায়। নানা টেনশন আর কাজের চাপে আত্মিক সুখানুভূতির জায়গাটা অনেক কমে যায় অনেকের। সে ক্ষেত্রে তারা কী করে ওয়ার্ক লাইফটার ব্যালেন্স করবে? ষ এক নম্বর আমি যেটা বলব, যদিও সেটা শুনতে অনেক ক্লিশে শোনায় তাও বলব, টাইম ম্যানেজমেন্ট। টাইম ম্যানেজমেন্ট করলে কিছুটা তো চাপ কমে যায়ই। তবে সম্পূর্ণ যে দেয়া যায় তা নয়, কিন্তু ঘরের সঙ্গে বাইরের একটা তাল রাখতে গেলে সেখান টাইম ম্যানেজমেন্ট একটা বড় ফ্যাক্টর। এতে ঘরের কাজের সঙ্গে বাইরের কাজে সামঞ্জস্য কিছুটা তালের মিল ঘটে। নারী শুধু নয়, একজন পুরুষকেও কিন্তু একাধিক কাজের সমন্বয় ঘটাতে গেলে পারফেক্ট টাইম ম্যানেজমেন্টর দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। একই দিনে তার হয়তো বোর্ড মিটিং আছে বা একই দিনে তার হয়তো কোনো প্রজেক্ট আছে সেটা জমা দেয় কিংবা টিম মেম্বারদের সঙ্গে মিটিং, সেগুলোর জন্যও কিন্তু টাইম ম্যানেজমেন্ট দরকার। তাই সব নন্দীনির জন্য আমি বলবো, যারা গৃহিণী, কিংবা কর্মজীবী তাদের সবারই কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে সময় পরিকল্পনার একটা চমৎকার সমন্বয় ঘটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, কাজের দক্ষতা দরকার। সবকিছু যেন সুষ্ঠুভাবে করা যায়। এবং সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হওয়া দরকার। তবে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার উলেস্নখ না করলেই নয়, তা হলো ছোট ছোট পেটি ইসু্যগুলো ইগনোর করা গেলে কাজটাও সুষ্ঠু হয়, মনটাও ভালো থাকে। বড় ঘটনাগুলোর কারণ বড়, ছোট ঘটনাগুলো খুব বেশি গা মাখার না হলে সেগুলো মন থেকে ফ্ল্যাশ করে দেয়া উচিত। তাই না? যন্ত্রণা বড় যদি হয় তাহলে সাধ্যমতো সামাল দেব, আর ছোট হলে বেশি একটা গায়ে মাখা উচিত না। তবে পরিবারের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এবং কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে যদি সাপোর্ট সিস্টেম গড়ে তোলা যায় তাহলে অনেকটা সুবিধা হয়। আর এটা হলে মেয়েরা বেশ ভালোভাবে সামাল দিতে পারবে। প্রকৃতি যেমন অনেক কোমল তার আবার অনেক ক্ষমতা। তেমনি মেয়েরাও। এ কোমলমতিরা একসঙ্গে অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখে। ষ যখন কি না কোনো নারী খুব মেধাবী, অপ্রতিরোধ্য, সামনের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তখন সে নারীকে হয় তো পেছনের দিকে খামচে ধরে পুরুষতান্ত্রিক অসহোযোগিতা। কর্মক্ষেত্রে নারী কলিগসদের হিংসাত্মক মনোভাব, আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবদের কটূক্তি। তাদের জন্য যদি কিছু বলতেন- ষ এ ক্ষেত্রে আমি বলব, নিজের জায়গাটা আগে স্ট্রং করতে হবে। এটা আমি অনেক বিশ্বাস করি। আমি এই কনভিকশন থেকে কিন্তু নিজেও চলি। নারী যে কাজই করুক না কেন, হোক সেটা পড়াশুনা, চাকরি, বাড়ির গৃহস্থালি কাজ ইভেন সে যদি একজন হোম মেকারও হয় তবে সে চালনাটা এমনভাবে করবে যেন তা যথাযথ হয়। সুপার এফিসিয়েন্ট যাকে বলে। নিজের কাজের জায়গাটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে শক্ত করে ধরে রাখতে হবে এবং সেটা দক্ষ হাতে সামাল দিতে হবে। সেই সঙ্গে নিজের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। কর্মক্ষেত্রে যখন কোনো নারীকে সমালোচনা শুনতে হয় বা ব্যাকবাইটিং কিংবা কখনো-সখনো সম্মুখেও কটূক্তি শুনতে হয়। কিন্তু তখন তাতে মন খারাপ করলে চলবে না কিংবা ভেঙে পড়লে চলবে না। সেটাকে কনটেস্ট অনুযায়ী বিচার করতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খেয়াল করবে এ ধরনের কথাগুলো বলে অপটু ও হিংসুটে মানুষরা। তো সেটা মাথায় রেখে অযথা চাপ বাড়ানোর তো দরকার নেই। বরং যেটা দরকার তা হলো কনফিডেন্স। আত্মবিশ্বাস। 'আমি পারি'- এই কনফিডেন্সটা নিজের মধ্যে গ্রো করতে হবে। এই কনফিডেন্সটা আসবে কোথা থেকে? আসবে শিক্ষা থেকে, কাজের দক্ষতা থেকে, নিজের নৈতিক বোধ থেকে। নারী ক্ষমতায়নের যুগে এটা থাকা খুব জরুরি। ষ অনেক সময় এমনও হয়, সবচেয়ে কাছের মানুষটি যে কি না স্বামী-পতি-বর; যাই বলি না কেন, তার কাছ থেকেও অনেক নারী পান ঔদাসীন্য এবং নীরবতা। 'স্ত্রী আমার থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে' কিংবা 'স্ত্রী আমার চেয়েও অনেক বেশি ইনকাম করছে' এ ধরনে আত্মপীড়নে ভোগেন অনেক স্বামী প্রবর। যা উদ্যোমী নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অসহযোগিতারই নামান্তর। আপনার দৃষ্টিকোণ কী বলে? ষ প্রেক্ষিত অনুযায়ী অনেক কিছু পাল্টে যায়। তুমি যখন অনেক ভালো একটা কিছু করে ফেলবে তখন স্বাভাবিকভাবেই দেখবে কখনো কখনো কোনো কোনো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একটু হিংসাত্মক অনুভূতি জাগে। এটা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সংসারের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে কাছের মানুষ হাসবেন্ডের মধ্যে এ ধরনের বিপরীত বোধ যখন জাগ্রত হয়, তখন শুরুতেই এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। ঠিকমত সেটা হ্যান্ডেল করতে হবে। হ্যান্ডেলিং ইজ ভেরি ইম্পর্টেন্ট। সেখানে তোমার বুদ্ধির দরকার। কাজের দক্ষতা থাকলে উপস্থিত বুদ্ধিটা এমনিতেই চলে আসে। আর ক্রুশিয়াল যে ব্যাপারটা তুমি বললে, স্ত্রীকে নিয়ে স্বামীর মধ্যে যে ইনফিওরিটি কমপেস্নক্স হয় সেটা কিন্তু প্রথম থেকেই মোকাবেলা করা দরকার। অবশ্য সংসার যাত্রার শুরু থেকে যদি দুজনের আন্ডারস্টেন্ডিংটা থাকে, তাহলে এই কমপেস্নক্সেও সূত্রপাতই হয় না। কেননা, দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হলে তবেই তো তারা সংসারযাত্রাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাহলে সেখানে- আমি যাকে ভালোবাসি তার কোনো সাফল্য দেখে আমার হিংসে হবে কেন? কিন্তু তা অনেক ক্ষেত্রে হয়। আর সে জন্য আত্মবিশ্বাসের ভিতকে আগে মজবুত করতে হবে। শান্তভাবে চিন্তা করে এর কারণটা বের করতে হবে। ষ একজন নারী, হয়তো সে তরুণ, হয়তো সে কাঁচা। 'কর্মস্থলের অভিজ্ঞতা' নামক ভারী ট্যাগটি হয়তো তার সিভিতে এখনো লাগেনি। তবু তার রয়েছে মেধা, উদ্ভাবনীশক্তি আর পরিশ্রম ক্ষমতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে অনেকের সহযোগিতা পায় না। কিংবা নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে শুরুতেই দমে গেল। ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন আর দমে যাওয়া মন নিয়ে সে পেছাতেই থাকল। সে কেমন করে তার মনোবলটা রাখবে? কী করলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়টা ঘুচবে? ষ কর্মক্ষেত্রের কথাই যখন বলছ, তখন বলব দমে গেলে চলবে না। দমে যাওয়া শব্দটা আমার অভিধানে নেই। কারোরই থাকা উচিত না। বিশেষত যারা নতুন কিছু করতে চায়, অরিজিনাল আইডিয়া যাদের আছে তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় এমন হয় যে যথাযথ সাপোর্টটা হয়তো সে পাচ্ছে না। তো সে ক্ষেত্রে বসে বসে অযথা সেটা বাড়তে না দিয়ে চেষ্টা করতে হবে উদ্যোমহীনতা থেকে বের হয়ে আসার। সমস্যাকে তো আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায় না, সমাধানের পথ দেখতে হবে। আর পজেটিভিটিটা একটা মস্ত জিনিস। জীবনের মূল মন্ত্র। নিজের জীবনের ক্ষেত্রে, সাফল্যেও ক্ষেত্রে পজেটিভিটির দিকটা অবশ্যই থাকতে হবে। সমস্যা আসবেই। একবার হেরে গেলে পিছিয়ে আসা যাবে না। পস্ন্যান বি সি ডি ক্রমান্বয়ে তৈরি করতে হবে। সমস্যাগুলোকেই সমাধানের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার পথে সিঁড়ি বানাতে হবে। তবেই আমি মনে করি, নন্দিনীদের স্বপ্ন সত্যি হবে। নতুন উদ্যোমে, গর্বের সঙ্গে তারা এগিয়ে যাবে তাদের লক্ষ্য অর্জনে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।