নারীর স্বাধীনতা হোক অবারিত

প্রকাশ | ০৬ মে ২০১৯, ০০:০০

মাসুমা রুমা
পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস থেকে নারীর পায়ে যে অদৃশ্য শিকল পরিয়ে দেয়া হয়েছে, তা ভেঙে ফেলার মতো মনোভাব, চিন্তা-চেতনার প্রসারতা, মানসিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, স্বদিচ্ছা আজও তৈরি হয়নি অধিকাংশ নারীর হৃদয়ে ছবি : ইন্টারনেট
ইংরেজিতে একটা কথা আছে- 'গধহ রং নড়ৎহ ভৎবব নঁঃ বাবৎুযিবৎব যব রং রহ পযধরহং.' এই কথাটি পৃথিবীর সব মানুষের উদ্দেশে বলা হলেও কথাটি যেন প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রে ধ্রম্নব সত্যের মতো। একজন নারীর জন্ম থেকে মৃতু্য পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে নারীর জীবন কতটা ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার পেছনে যে কেবল পুরুষ সমাজ দায়ী তা নয়, বরং নারী সমাজও সমানভাবে দায়ী। নারীরা পুরুষের মতো পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করলে পৃথিবীটা আরও বেশি সুন্দর এবং উন্নত হতে পারত। পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস থেকে নারীর পায়ে যে অদৃশ্য শিকল পরিয়ে দেয়া হয়েছে, তা ভেঙে ফেলার মতো মনোভাব, চিন্তা চেতনার প্রসারতা, মানসিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, স্বদিচ্ছা আজও তৈরি হয়নি অধিকাংশ নারীর হৃদয়ে। ফলে নারীরা আজও প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। সব ক্ষেত্রে সমান অবদান রাখতে পারছে না। যন্ত্রণাকে ভুলে যেতে কেউ বা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো জঘন্য মুক্তির পথ। নারী স্বাধীনতার কথা বলতে গেলেই বেগম রোকেয়ার কথা উঠে আসে। যে সময় আর যে পরিবেশে তিনি নারীর স্বাধীনতার জন্য আমৃতু্য লড়াই করে গেছেন, ভাবতে গেলেই বিস্মিত হতে হয়। বেগম রোকেয়া কী কোনো অতি মানব ছিলেন? না। তিনি আমাদের মতোই একজন রক্ত-মাংসের সাধারণ মানুষ ছিলেন। তাহলে তিনি যদি শত বছর আগে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন, আমরা যারা আজকের নারী সমাজ তারা কেন পারব না? আমরা তো এখন আগের তুলনায় সব ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা ভোগ করছি। পূর্ণ স্বাধীনতার পরশ পেতে হলে এখনই সোচ্চার হতে হবে। চিন্তার লাগাম খুলতে হবে। সীমাবদ্ধতাকে ঘৃণা করতে হবে। নিজেকে একজন নারী নয়, সবার আগে একজন মানুষ ভাবতে হবে। আর সব মানুষের জন্য একই আইন, একই অধিকার। প্রথমে আসব নারীর শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রসঙ্গে। গ্রামাঞ্চলে এখনও নারী শিক্ষার বেহাল অবস্থা। অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়। বাল্যবিয়ের দৌরাত্ম্য আজও সে অর্থে কমেনি। অনেক নারী পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করতে ইচ্ছুক; কিন্তু বাবা-মার ইচ্ছার কাছে তাদের দীর্ঘদিন লালন করা স্বপ্নগুলোকে মাটি চাপা দিতে হয়। ফলে একটা ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে সে স্বামীর ঘরে পা রাখে। গত পরশু আমার একজন পরিচিত ব্যক্তি ফোন করে জানালেন তার পরিবার তাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু সে এখন মোটেই বিয়ে করতে চায় না। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে অন্যের জীবনে সে যেতে রাজি না। আমি তার ইচ্ছার প্রতি পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম। সে আমার কাছে জানতে চাইল তার এখন করণীয় কী। আমি তাকে বললাম- তুমি তোমার মাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলো। তিনি তো একজন নারী। তিনি নিশ্চয় তোমার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারবেন। সে বলল, বাবা আর ভাই যতটুকু বুঝবে মা সেটুকুও বুঝবে না। বুঝুন তাহলে এই আমাদের নারীসমাজ! অনেক নারী স্কলারশিপ পেয়ে বাইরের দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার সুযোগ পেলেও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাকে যেতে দেয়া হয় না। ফলে যে নারী উচ্চ শিক্ষিত হয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনতে পারত সে নারী দেশেই পরে রইল। নারীই নারীর পথে বড় বাধা। বেশির ভাগ পারিবারিক বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর মতামত জানতে চাওয়া হয় না। আসলে মতামত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করে না। ফলে সাংসারিক জীবনে নারীর সুখী হওয়াটা অনেকটা জুয়া খেলার মতো হয়ে দাঁড়ায়। সাংসারিক জীবনেও নারী কতটা অসহায়! পারিবারিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে একজন নীরব দর্শক মাত্র। ভালো লাগুক আর না লাগুক সবকিছুকে সায় দিতে হয় তাকে। চোখের সামনে অন্যায় দেখলেও তাকে মুখ বুজে সহ্য করে নিতে হয়। এর বড় একটা কারণ নারীরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল। দুর্বল জায়গায় আঘাত করা মানুষের আজন্ম স্বভাব। অনেক নারী আবার অধিকার আদায়ে কিছুটা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও অনেক নারী চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। স্বামীর অবাধ্যতার প্রতিশোধস্বরূপ অধিকাংশ পুরুষ সে নারীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো মারাত্মক ঘটনাও ঘটে থাকে। যার প্রভাবে নারী মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নারীর মুক্তি কি তবে আমৃতু্য অন্যায়কে হাসি মুখে মেনে নেয়ার ভেতর, নাকি আজীবন নিজের সত্তার অপমৃতু্য ঘটিয়ে পুরুষের দাসীবৃত্তি করার ভেতর? অধিকাংশ পুরুষই হয়তো 'হ্যা' বলে উঠবেন। তাতে আশ্চর্যের কিছু দেখি না। যুগ যুগ ধরে এমন মনোভাব তো তারা পোষণ করেই আসছেন। যা করার করতে হবে নারীদেরকেই। মাথা উঁচু করে বাঁচতে, অধিকার আদায় করে নিতে, সঠিক পথে যা যা করতে হয় সবই করতে হবে নারীদের। অন্যথায় মুক্তি মেলবে না। এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগের অধিকার নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান। নদী, পাহাড়, সমুদ্র, সবুজ প্রকৃতিতে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পুরুষের ন্যায় নারীর ভেতরেও সমানভাবে বিদ্যমান। একজন পুরুষ চাইলেই দেশের যে কোনো প্রান্তে বা বাইরের দেশে যেতে পারেন। কিন্তু একজন নারী চাইলেই কি সেটা পারেন? পারেন না। কেন পারেন না? নিরাপত্তার অভাবে। নারীরা কাদের হাতে নিরাপদ না? বুঝতেই পারছেন পুরুষের হাতে। একজন নারীকে ঘুরতে যেতে বাধা দেবেন নারীর পিতা, ভাই, মামা, চাচা বা অন্য কেউ। কথা হলো- এই আপনাদের মতোই অন্য কারও পিতা, ভাই, চাচা, মামার হাতে আপনার কন্যা, বোন, স্ত্রী, মা, খালারা নিরাপদ নয়। কাজেই নিরাপত্তার অভাব এ দায়ভারটা কার? নারীর নাকি পুরুষের? নারী হোক বা পুরুষ হোক, স্বাধীনতা ভোগ না করলে কেউ-ই স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে না। আর চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে সে দেশের মানুষের দ্বারা যথার্থ উন্নতি সাধন সম্ভব নয়। শুধু শিক্ষিত মানুষ রাষ্ট্রের কল্যাণ বয়ে আনে না। কল্যাণ বয়ে আনে সশিক্ষিত আর সুশিক্ষিত নাগরিক। যতদিন না নারী-পুরুষ উভয়ই প্রকৃত শিক্ষার সংস্পর্শে না আসবে ততদিন জাতির ভাগ্য বদলাবে না। নারীর মুক্তিও আসবে না সে অর্থে।