স্বাধিকারের অগ্নিকন্যা

প্রকাশ | ০৬ মে ২০১৯, ০০:০০

তানিয়া তন্বী
আত্মদানের ইতিহাস রচনা করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত প্রীতিলতা। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ইতিহাসে অমর হয়েছেন। উপমহাদেশের একটি ছোট এলাকা চট্টগ্রামের বীর কন্যা প্রীতিলতার স্বাধীনতার স্বপ্ন ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগে শেষ হয়নি। ১৯৭১ সালে আরও শত শত প্রীতিলতার জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণে। ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পাহাড়বেষ্টিত ভূখন্ড। কর্ণফুলী নদীর উত্তাল স্রোত এসে যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে সেই পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আমাদের অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা। প্রীতিলতার বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার, মায়ের নাম ছিল প্রতিভা দেবী। পরিবারের ৬ ভাই বোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিল দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকে অন্তর্মুখী, লাজুক ও মুখচোরা ছিলেন। মৃতু্যর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নম্রতা, বদান্যতা, রক্ষণশীলতা লালন করেছিলেন। প্রীতিলতা ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ নারী বিপস্নবী। বিএ পাস করে তিনি চট্টগ্রামের নন্দনকানন অর্পণাচরণ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। ইডেন কলেজে পড়ার সময় বিপস্নবী সংগঠন 'দীপালি সংঘ' ও বেথুন কলেজে থাকতে 'ছাত্রী সংঘের সক্রিয় কর্মী হলেও মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি স্কুলের শিক্ষকতায় যোগদানের পর। তবে প্রীতিলতা যখন চট্টগ্রামের ড. খাস্তগীর স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, তখন দেখলেন যে মাস্টারদা সূর্যসেন ও আম্বিকা চক্রবর্তীকে রেলওয়ের টাকা ডাকাতির অপরাধে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপস্নবী নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্র লুট, রেললাইন উপড়ে ফেলা, টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল করে দেয়াসহ ব্যাপক আক্রমণ হয়। এ আক্রমণ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ নামে পরিচিতি পায়। এ আন্দোলন সারাদেশের ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। চাঁদপুরে হামলার ঘটনায় বিপস্নবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ হয় এবং তিনি আলীপুর জেলে বন্দি হন। প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের বোন পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতেন। রামকৃষ্ণের প্রেরণায় প্রীতিলতা বিপস্নবী কাজে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩১ সালে ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণের ফাঁসি হওয়ার পর প্রীতিলতা আরও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। ওই সময়ের আরেক বিপস্নবী কন্যা কল্পনা দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় প্রীতিলতার। বিপস্নবী কল্পনা দত্তের মাধ্যমে মাস্টারদার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন প্রীতিলতা। ১৯৩২ সালের মে মাসে প্রীতিলতার দেখা হয় মাস্টারদা ও বিপস্নবী নির্মল সেনের সঙ্গে। তার কাছ থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ লাভ করেন। জুন মাসে বিপস্নবীদের শক্ত আস্তানা প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাস্টারদা তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করার সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। বিপস্নবীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যুদ্ধে প্রাণ দেন, নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন' অন্যদিকে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন নিহত হন। এ ঘটনার পর পুলিশ সাবিত্রী দেবীর বাড়ি পুড়ে দেয়। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে বাড়ি ফিরে স্কুলে যোগ দিতে বলেন। কিন্তু প্রীতিলতার ওপর পুলিশের নজরদারি বেড়ে যায়। এ কারণে জুলাই মাসে প্রীতিলতাকে আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দেন মাস্টারদা। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের তো ১৯৩২ সালে আবার ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ওই বছর ১০ আগস্ট আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে নারী বিপস্নবীদের নেতৃত্বে আক্রমণ হওয়ার কথা হয়। আর নেতৃত্বে থাকে কল্পনা দত্ত; কিন্তু আক্রমণের আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কল্পনা দত্ত। তাই নেতৃত্ব দেয়া হয় প্রীতিলতাকে। ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে সফল হন বিপস্নবীরা। প্রীতিলতা সেদিন পুরুষবেশে আক্রমণে যোগ দেন। জয়ী হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন প্রীতিলতা। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগেই সঙ্গে থাকা সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন তিনি। বিপস্নবী আন্দোলনের পাশাপাশি নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন প্রীতিলতা, শেষ মুহূর্তেও তিনি বলেছিলেন 'নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়েছে যে, আমার দেশের ভাগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।' বর্তমান সমাজ ভুলে যায় সেই অতীতে অগ্নিযুগের কন্যারা নারী হিসেবে নয় মানবিকতা সাহসীকতার দিক দিয়েই তারা দেশের জন্য সংগ্রাম করেছে। প্রীতিলতার আদর্শ আমাদের পথের সম্ভাবনা হয়ে থাকবে।