শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১

নারী কি আসলেই স্বাধীন?

যে রাষ্ট্র প্রগতি, ন্যায়বিচার, সমতার কথা বলেছিল, সেই রাষ্ট্র নারীকে সমান অধিকার দিতে রাজি নয়। দোহাই দেওয়া হয় ধর্মের। তারা বলে, নারী-পুরুষের সমতা ধর্ম সহ্য করবে না। ধর্মীয় নেতারা আরও বেশি বিক্ষোভ করবে। অনেক অজুহাত। যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না, ওই সময়গুলোতেও ধর্মের লেবাসটাকে তোয়াক্কা না করে পরিবর্তন আনার সুযোগ ছিল। এমনকি পরাধীন পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান ১৯৬১ সালে পারিবারিক আইনের মধ্য দিয়ে অনেক মৌলিক পরিবর্তন এনেছিলেন ধর্মের বিরোধ উপেক্ষা করে। পুরুষের বহুবিবাহ রোধে বড় অবদান রেখেছিল সেই আইন। সমান অধিকার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে নারীর মর্যাদা অনেক ওপরে নিয়ে যেতে পারত। সমাজ-পরিবার-প্রতিষ্ঠান-বিচার ব্যবস্থা বাধ্য হতো। কিন্তু আমরা সেটা পেলাম না
শরীন হক
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নারী কি আসলেই স্বাধীন?

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমার বয়স আঠারো বছর। বাগান করতে পছন্দ করতাম। ধানমন্ডিতে আমার মায়ের বাসায় গোলাপ বাগান ছিল। তখন চারদিকে অত উঁচু উঁচু ভবন ছিল না রোদ আসত সরাসরি। অনেক ফুল হতো। যেদিন বিজয়ের ঘোষণা হলো, সব গোলাপ কেটে বাসা থেকে বের হয়ে দৌড়াতে থাকলাম। তখন বিজয়ের আনন্দ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরছে। কেউ ট্রাকে করে, কেউ জিপে করে ফিরছে। ফুটপাত ও চারদিকে মানুষ, উলস্নাস করছে সবাই। তাদের দেখে বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছে। আমার উলস্নাস দেখে কে! আমি হাতের ফুলগুলো যতজনকে দেওয়া যায় দিলাম। আমি ভেবেছিলাম আমরা সবাই সেদিন স্বাধীন হয়ে গেছি। ভুল ভেবেছিলাম। ডিসেম্বরের ১৬ থেকে ২১ ফেব্রম্নয়ারি, দুই মাস। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম একুশে ফেব্রম্নয়ারি। শহীদ মিনারে উপচে পড়া ভিড়। মানুষ খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে যেমন পারে তেমন ফুল নিয়ে গেছে। কেউ একটা, কেউ দু'টি, কেউ ফুলের তোড়া নিয়ে গেছে। বিশাল উৎসব। সেদিন অনেক নারী গিয়েছিল। আমিও গিয়েছিলাম। আমি কোথাও গেলে মায়ের সঙ্গে যেতাম। সেদিন কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গেছি। সেদিন আমিসহ অনেক নারীর গায়ে এমনভাবে হাত পড়ল! এরপর থেকে অনেক দিন শহীদ মিনারেও যাইনি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও আমাদের স্বাধীনতা আসেনি তা বুঝতে হলো এভাবে। মেয়েদের জন্য এখনো কোনো পাবলিক পেস্নস নিরাপদ নয়। জাতীয় উদযাপনের একটা দিন একুশে ফেব্রম্নয়ারি। সেই জাতীয় একটা দিন উদযাপনের অধিকার নারীদের নেই। কারণ তারা সেখানে নিরাপদ নয়। ৫২ বছর পর এখনো আমি শুনি কোনো ভিড়ের মধ্যে গেলে নারীদের গায়ে হাত পড়ে। মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার প্রবণতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এটা আমাদের স্বপ্নভঙ্গের একটা অধ্যায়। পাশাপাশি স্বপ্ন অর্জনেরও দিক আছে। এখন মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরাও দূরদূরান্তের স্কুলে যায়। তবে স্কুলে যেতে গিয়ে পথেঘাটে বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে মেয়েরা। এ জন্য এখনো বাল্যবিয়ে হ্রাসের জায়গায় তেমন উন্নতি ঘটেনি। পৃথিবীর এগারোটা রাষ্ট্রে বাল্যবিয়ের হার অত্যধিক। তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

রাষ্ট্রের কাছে নারী, নারীর ভালো থাকা, নারীর অধিকার বঞ্চনা, নারীর অধস্তনতা প্রাধান্য পায় না। স্বাধীনতা আমাদের জন্য নয়। মেয়েদের নিয়ে বাবা-মা আতঙ্কিত থাকে। যেই মেয়ে একটু বড় হয়, বাবা-মা বিয়ে দিতে চায়। পড়াতে গেলে মা-বাবার বাড়িতে থেকে যদি কোনো অঘটন হয়, তাহলে এই মেয়েকে কোনো দিন বিয়ে দিতে পারবে না। মূল্যবোধ ও নর্মসের জায়গায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। একেবারে যে হয়নি তা নয়। তবে মেয়েদের বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি অর্জন করতে পারিনি। বাল্যবিয়ে ঠেকানোর জন্য আমরা ভালো ভালো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। বৃত্তি দিচ্ছি। বাল্যবিয়ে ঠেকানোর কারণ হলো মেয়েরা মানুষ হবে, নিজ পায়ে দাঁড়াবে সেটা নয়। লক্ষ্য হলো পরিবার পরিকল্পনা এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। মেয়েরা মানুষ হয়ে মর্যাদা অর্জন করবে সেটা প্রাধান্যের জায়গায় নেই। এমনকি মেয়েরা নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার পাবে, এতে অনেক সংসদ সদস্য দ্বিমত করেন। আমরা সবকিছুতে সমান অধিকার পাব সেটা তারা চান না। এত কিছু সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও সমাজের সহায়তা ছাড়াই এগিয়ে যাচ্ছে নারী। মেয়েরা লেখাপড়ার দিক থেকে অনেক অনেক এগিয়েছে। ৭২ সালে কী ছিল আর এখন কী! বলা যায়, বিশাল অগ্রগতি। জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার ফলাফলেও মেয়েরা এগিয়ে। ছেলেদের চেয়ে বেশি উত্তীর্ণ হচ্ছে। একাই লড়াইগুলো করে যাচ্ছে মেয়েরা। আমাদের সময়ে আমরা অতটা পারিনি। ওদের অভিবাদন জানাই। ওরা বাসে চড়ে, পেছনে বসে। অনেকভাবেই তারা বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে পড়ালেখা শেষ করছে। তারা মনে করছে, পড়ালেখা তাদের অস্ত্র- তারা সফল হচ্ছে। অভিবাদন পাওয়ার যোগ্যতা সমাজের নয়- এই মেয়েগুলোর। আরও অনেক দিক আছে। মেয়েদের বড় অগ্রগতির জায়গা হলো, তারা বলছে, একটা ছেলে সন্তানের আশায় ৭টা মেয়ে সন্তান নেব না, শরীর পারবে না। মেয়েরা এই ব্যাপারে স্পষ্ট। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারীরাও এখন অনেক সচেতন। আগে তারা পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানত না। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা সবকিছু থেকে বঞ্চিত ছিল। ওদের একেকজনের ৭ থেকে ১০টা করে সন্তান ছিল। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে দেখেছি, ৩০-৩২ বছর বয়সি একজন নারীর ৯টা সন্তান। সে বলে, আমি আর পারছি না। আমার স্বামী বা অন্যরা কে কী বলে, তা শুনব না। আমাকে আপনারা ব্যবস্থা করে দেন। আরও অনেককেই দেখেছি, যাদের বয়স ২০-২২, তাদের দু'টি সন্তান, তারা বলছে, আর না। 'আর না' বলতে পারছে এটাই অনেক। বাংলাদেশি নারীরা 'না' বলার এই অধিকার অনেক আগেই অর্জন করেছে। রোহিঙ্গারা মাত্র শুরু করেছে। আমরা যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখি তাহলে দেখবেন, হার অনেক কমেছে। এটা যতখানি পুরুষের কৃতিত্ব, তার চেয়ে বেশি নারীদের কৃতিত্ব, নারীদের অর্জন। এর জন্য কী তারা পুরস্কৃত হচ্ছে? সে তার জীবন ও শরীর নিয়ে বাঁচতে পারছে নিজ চেষ্টায়, এর জন্য কৃষক যেমন কোথাও থেকে পুরস্কার পায় না, নারীও পায় না। তাদের দৈনন্দিন জীবন তাদের ছাড় দেয় না। ঘর বা সংসারে পরিবর্তনের ছোঁয়া খুব একটা আসছে না। এখন নারী ও পুরুষ দু'জনই কাজ করতে বাইরে যাচ্ছে। নয়তো সংসার চালানো দায়। দু'জনের আয় দিয়ে সংসার চলে। নারীরা ঘরের কাজও করছে, বাইরের কাজও করছে। পুরুষরা কিন্তু শুধু বাইরের কাজই করছে, ঘরের কাজ সেভাবে করছে না। ভালো সংবাদ হলো, এ যুগের কিছু ছেলে স্ত্রীর পাশাপাশি সংসারের কাজ করে। কিন্তু অধিকাংশই করে না। এসব জায়গায় নারীদের কষ্টার্জিত অর্জনের জন্য কেউ ছাড় দিচ্ছে না। এগুলো আমাদের কষ্টের জায়গা। অধিকারের কথা বলতে গেলে লজ্জাই লাগে।

যে রাষ্ট্র প্রগতি, ন্যায়বিচার, সমতার কথা বলেছিল, সেই রাষ্ট্র নারীকে সমান অধিকার দিতে রাজি নয়। দোহাই দেওয়া হয় ধর্মের। তারা বলে, নারী-পুরুষের সমতা ধর্ম সহ্য করবে না। ধর্মীয় নেতারা আরও বেশি বিক্ষোভ করবে। অনেক অজুহাত। যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না, ওই সময়গুলোতেও ধর্মের লেবাসটাকে তোয়াক্কা না করে পরিবর্তন আনার সুযোগ ছিল। এমনকি পরাধীন পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান ১৯৬১ সালে পারিবারিক আইনের মধ্য দিয়ে অনেক মৌলিক পরিবর্তন এনেছিলেন ধর্মের বিরোধ উপেক্ষা করে। পুরুষের বহুবিবাহ রোধে বড় অবদান রেখেছিল সেই আইন। সমান অধিকার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে নারীর মর্যাদা অনেক ওপরে নিয়ে যেতে পারত। সমাজ-পরিবার-প্রতিষ্ঠান-বিচার ব্যবস্থা বাধ্য হতো। কিন্তু আমরা সেটা পেলাম না।

আমার মা বলতেন, তার সময়ের নারী ও এই সময়ের নারীদের মৌলিক জায়গাগুলোয় পরিবর্তন নেই। তিনি বলতেন, 'দেখ, আমার সময়ে বাবা-মায়েরা ভাবত ১৫-১৬ বছর বয়স হলেই তার চেয়ে ৭-৮ বছরের বড় এবং ভালো চাকরি করে এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারাটাই সাফল্য। এখনো মেয়ের জন্য আকাঙ্ক্ষা করে একজন ভালো জামাই। ভালো জামাই বলতে বোঝায় ভালো রোজগার করে, ভালো সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি। তো কীভাবে পরিবর্তন হলো?' এখন মেয়েরা নিজেরা অনেকেই প্রতিবাদ করে। পত্রিকায় পড়েছি আঠারোর কম বয়সি একটি মেয়ে বিয়ের আসর থেকে ওঠে গেছে। এই প্রতিবাদ করতে পারা বিশাল ব্যাপার। নিজের ওপর বিপুল বিশ্বাস ও আস্থা থাকলে এটা করা যায়। একজনকে দেখে অন্য মেয়েরা সচেতন হয়। বিয়ের অধিকারটা যে বাবা-মায়ের না, বিয়ের অধিকার যে একটা ছেলে ও মেয়ের- এটা এখন বিবেচনায় এসেছে। এখন ছেলেমেয়েরা বলতে পারছে, আমার জীবন আমি দেখব। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক ও ওষুধ উৎপাদন। এই খাতগুলোয় বেশির ভাগ শ্রম দেন নারীরা। এ দু'টি ক্ষেত্রে আমাদের রপ্তানি আয় অনেক বেড়েছে। এটি মেয়েদের অর্জন। অনেক ক্ষেত্রে স্বীকার করা হয়, এটি মেয়েদের অর্জন। কিন্তু পারিবারিক বলয়ে সমতুল্য পরিবর্তন এখনো ঘটেনি। এই মেয়েরাই বাসায় ফিরে রান্না করে এবং পরদিন খুব সকালে ওঠে রান্না করে ঠিক সময়ে কারখানায় পৌঁছায়, দেরি হলে টাকা কাটা যায়। তারা অনেক উপার্জন করছে বলা যাচ্ছে না। তাদের শ্রম এখনো সস্তা হলেও উপার্জন করছে- যা সংসারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে মেয়েটার আয় ছাড়া হয়তো সংসার চলতে পারত না, কিন্তু মেয়েটার শরীরটা কেমন আছে, জ্বর এসেছে কিনা, তার খোঁজ কমই নেওয়া হচ্ছে। রাতে বাসায় ফিরে রান্নাঘরে ঢুকতে হচ্ছে। মানসিকতা ও আদি কাঠামোগত কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসছে না। নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার পাচ্ছেন। কিন্তু মেয়েদের পরিশ্রমের তীব্রতা বাড়ছে। ঘরে-বাইরে দু'টিই সামলাতে হয়। ছেলেদের সঙ্গে যে অসমতা, সেটা কমছে না। সেটা না কমলে ক্ষমতায়ন কথাটা ব্যবহার কতটা যৌক্তিক। এসব প্রতিবন্ধকতা এড়ানোর জন্য রাষ্ট্রকে সাহসী হতে হবে। রাষ্ট্রকে তার মধ্যযুগীয় মানসিকতা বর্জন করে নারীর সমতার অধিকারকে সমুন্নত রাখতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে নানাবিধ ও বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে