শতাব্দীর একাল-সেকাল

প্রকাশ | ২৭ মে ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
অলংকরণ : নিসা মাহজাবিন
মুশফিকা মোশাররফ শিলু (পূর্ববর্তী সংখ্যার পর) আজকাল ফেসবুক নামে একটি সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার চল আছে, যেখানে মানুষ ইচ্ছে করলেও নিজের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারে না অথবা এখনকার মানুষ গোপনীয়তায় বিশ্বাসীই নয়। নিজের জীবনের প্রতিটি পর্ব সারা দুনিয়াকে জানাতে বা দেখাতে না পারলে স্বস্তিবোধ করে না। ফলে ব্যক্তিগত অনেক বিষয় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয়ে থাকে। ফেসবুকের বদৌলতে সমাজের প্রতিটি মানুষের অযাচিত সাহস বেড়েছে- যা অনেক সময়ই বিপদ ডেকে আনে। এই ফেসবুকের কারণে ব্যক্তিগত দুঃখ আর ব্যক্তিগত থাকে না; তা আপামর জনসাধারণের দুঃখে বা হাস্যরসে পরিণত হয়। তাতে করে মানুষের আত্মমর্যাদা কি বজায় থাকে? আমার তা মনে হয় না। নিজের স্বকীয়তা নিয়ে বাঁচার মজাই আলাদা। সেটা আমরা বোধ হয় আর চাইও না; তাইতো ইদানীং ফেসবুকে অনেকেই অনলাইন হয়ে জনগণের সঙ্গে নিজেদের দুঃখ-সুখের কথা, কষ্ট, শখ, বিরক্তি, আনন্দ সবই আলোচনা করে থাকে। এই অনলাইনে আসার ঘটনাগুলো ঘটে মধ্যরাতে। মধ্যরাত হওয়া উচিত বিশ্রামের, শান্তি আর ঘুমানোর। মধ্যরাতটা নিজেকে নিয়ে ভাবার, স্বপ্ন বোনার, পরের দিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করার! এ সময়টা সারা দুনিয়ার লোকেদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে নিজেরা নিজেদের একা করে দিচ্ছে। মায়ের সঙ্গে, বোনের সঙ্গে, ভাইয়ের সঙ্গে, খালা, মামা, চাচা, চাচির সঙ্গে যে বিষয়গুলো আলোচনা করে যে সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় তা কি সারা দুনিয়ার মানুষ দিতে পারে? আমরা ফেসবুকের পরিমিত ব্যবহারে অভ্যস্ত হলে হয়তো সমাজের অনেক দুর্ঘটনা কমিয়ে অনা যেত। অশ্লীলতা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, একে অন্যকে খোলাখুলি দোষারোপ করা, ডিভোর্স ইত্যাদি আরো অনেক ঝামেলা নাও হতে পারত। এ সময়ে টিকটক নামে একটা অ্যাপ চলছে, সেখানে দেখা যায়, মানুষ তার পছন্দ অনুযায়ী চরিত্র ধারণ করে নানান রকমের ঢং ঢাং করে। যারা নাটক বা অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত তারাও এই টিকটক করে! কেন এটা তাকেও করতে হয়? সে তো অভিনয় পেশাতেই আছে! একটি মেয়ের নতুন বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে আছে, বৌভাতের অপেক্ষায় আছে; সেও পরিবারের সবার অলক্ষ্যে টিকটকে নানান অংগভঙ্গি করছে! হয় কোনো সিনেমার গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলাচ্ছে, না হয় চুমু দেয়ার ভঙ্গি (পাউট) করে টিকটক করছে! কী অদ্ভুত! এগুলো আসলে মানুষের একাকিত্বের পাগলামি! গল্প করার মানুষ থাকলে অথবা গল্প করতে ভালোবাসলে, অন্যের সঙ্গে বনাবনি মন নিয়ে থাকতে চাইলে মানুষ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই সময়টা পার করতে পারে, টিকটক করতে হয় না। মানুষের হাতে এখন এত অঢেল বিনোদনের অপশন; কোনটা নেবে কোনটা নেবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সিদ্ধান্তহীনতা আর একাকিত্বের থাবায় আটকে গেছে একবিংশ শতাব্দির মানুষ। এবার ইউটিউবের কথায় আসা যাক। শিক্ষণীয় অনেক বিষয় ইউটিউবে আপলোড করা হয়, রান্না, ঐতিহাসিক বিষয়, পৌরানিক বিষয়, প্রামাণ্যচিত্র ইত্যাদি আরো অনেক ধরনের শিক্ষণীয় বিষয়ে ভিডিও থাকে ইউটিউবে। নিশ্চয়ই এই বিনোদনটা আমরা উপভোগ করতে পারি! এই অ্যাপটিতে আবার কিছু নিন্দনীয় বিষয়ও আছে, কিছু অপপ্রচার আছে যা মানুষকে বিভ্রান্তও করে। কিছু যৌন শিক্ষার ভিডিও, যা অত্যন্ত নোংড়া, অপ্রয়োজনীয়। সুতরাং এই প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় এবং ব্যবহারই মানব মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও আজকাল আমরা ডিজিটাল! আগে অমরা, কড়কড়ে টাকা খরচ করে কেনাকাটা করতাম; এখন মেশিনে কার্ড ঢুকিয়ে টাকা দিয়ে দিই। সত্যিকারের টাকার চেহারাই দেখি না, টাকা বলতে এখন ওই কার্ডটাকে বুঝছি। ভুলে যাচ্ছি টাকা দেখতে কেমন। তবে কখনো কখনো এই ডিজিটাল টাকা লেনদেন আপাতদৃষ্টিতে মঙ্গলজনক, ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু কে জানে? উন্নত এই পৃথিবীতে এই ডিজিটাল সিস্টেমে আমরা আমাদের নিজেদের হারিয়ে ফেলছি কিনা? বা কোনো অন্য শক্তির কাছে নিজেদের বিক্রি করে ফেলছি কিনা! কোনো অপশক্তির মুষ্টিবদ্ধ হয়ে পড়ছি কিনা? অজানা ভয়, আশঙ্কা অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়েই প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীতে আমরা একালে জীবনযাপন করে চলেছি। আমরা এখনো পেছনের ফেলে আসা সোজা-সরল, ম্যানুয়েল জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছি। আমরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে আর কেউ থাকবে না কাঁচা টাকার গন্ধ চেনানোর, প্রেম-ভালোবাসার আবেগময় কাহিনী শোনানোর, ভূতের গল্প শোনানোর, ব্যর্থপ্রেমর যন্ত্রণায় সান্ত্বনা দেয়ার। একটা যন্ত্রমানবগোষ্ঠী একবিংশের পর এই পৃথিবীটাকে শাসন করবে!