শৈশবের ঈদের আনন্দ

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
রহিমা আক্তার মৌ সেই ৪০/৬০ বছর আগের ঈদ আর এখনকার ঈদ মিল আছে অনেকটাই। বদলেছে কিছু আচার-আচরণ, এটা অর্থের অভাব আর অর্থের জোগানের কারণেই। রমজানের ওই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ...। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এক অমর গান এটি। এই গানের সুরে প্রতিটি মুসলিম বাঙালির হৃদয়ের কোণে জেগে ওঠে ঈদের আনন্দ। এক মাস রোজা থাকার পর শেষ ইফতারের সঙ্গে সঙ্গে যখন ঈদের নতুন চাঁদ দেখা যায় তখন আনন্দ যেন একসঙ্গে উপচে পড়ে সবার ঘরে ঘরে। বাবা কখনই শাসন করতেন না, শহরে থাকতেন। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এলে আদরই করতেন। শাসনের পুরোটা ছিল মায়ের দখলে। ঈদের দিন সেই শাসনের কিছুই ছিল না বলে ঈদের আনন্দ ডাবল হতো আমার। নতুন পোশাক পরা, সেমাই খাওয়া, সেলামি নেয়া, সমবয়সীদের সঙ্গে হৈহুলেস্না করে বেড়ানোই ছিল ঈদ। আড্ডায় আমি নেই তো মজাই নেই। খুব মিস করি সেই শৈশবের ঈদকে। আমার মতো অনেকেই ঈদ আসলে হারিয়ে যায় নিজের শৈশব। কথা হয়েছে এমন কয়েকজনের সঙ্গে, বলেছেন উনাদের শৈশবের ঈদের কথা। রোকেয়া ইসলাম (কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার) \হ 'ঈদের আয়োজন আসলে রমজানের চাঁদ দেখার পর শুরু হতো। বলছি ১৯৬৮-৭০ সালের কথা। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, প্রথম রোজায় বারার সঙ্গে খলিফার দোকানে গিয়ে জামার মাপ দিয়ে জুতা কিনে বাসায় ফিরতাম। পুরো মাস অপেক্ষা করতাম কবে নতুন জামা পাব। শবে কদরের রাতের মেহেদী দেয়া দিয়ে শুরু হতো ঈদের আরেক আয়োজন। ঈদের দিন বাবা-চাচা- ভাইয়েরা সবাই সাদা পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজে যেতেন, এ এক অপূর্ব দৃশ্য ছিল। যত যাই হোক, ঈদের দিন নতুন সাবান দিয়ে আমার গোসল করতেই হতো। এই অভ্যাসটা এখনও আছে আমার। গোসলের পর গন্ধরাজ তেল মাথায় দেয়া এটাও ঈদের আনন্দ ছিল। নতুন জামা পরে সবাইকে সালাম করতাম। সালামির প্রচলন ছিল না তখন। আসলে ঈদকে কেন্দ্র করে সবার অনেক খরচ হতো, তার ওপর দু-এক টাকা সেলামি দেয়া যেত না। সালাম করার পর মুরুব্বিরা মাথায় হাত দিতে দোয়া করতেন, সেটাই ছিল আমাদের অনেক আনন্দের। দেলোয়ার হোসেন, (চাকরিজীবী, ঢাকা) 'চোখের কোণায় ভেসে উঠে সেই শৈশবের ঈদের স্মৃতি। ছোটবেলায় মা মারা যান, মায়ের অল্প কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। বাবার কাছে শহরে থাকতাম, সেখানেই লেখাপড়া। রমজানের ছুটিতে বাড়িতে। বাড়ি আসতে পুরো মাসের নিজের প্রয়োজনীয় সব নিয়ে আসতাম। বাবা ঈদের আগে নতুন জামা নিয়ে আসতেন। নতুন জামায় খুব একটা আগ্রহ ছিল না। ঈদের সকালে গোসল সেরে নামাজের আগেই যেতাম মায়ের কবর জিয়ারত করতে, নামাজ পড়ে আবার জিয়ারত করতাম। আমরা ১০/১২ জন সমবয়সীর একটা দল ছিল, সবাই একসঙ্গে সারাদিন এ বাড়ি ও বাড়ি এর আত্মীয় ওর আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরতাম। মো. হাফিজ রহমান (কবি, গল্পকার/উপমহাব্যবস্থাপক, তিতাস গ্যাস) 'নিম্নবিত্তের ঘরে জন্ম আমার। বাবা ছিলেন অসুস্থ, জমিজমা বিক্রি করেই মূলত খাওয়া পরা চলত। অনেকগুলো ভাইবোন। এমন সংসারে ঈদ? বাবা ছিল আলাদা বাড়িতে, আমি ছিলাম দাদা-দাদীর সংসারে। ঈদে প্রতিবেশী সঙ্গীদের নতুন জামা প্যান্ট নিতে দেখলে মনের মধ্যে কষ্ট হতো, পরে ভাবতাম, আমি জিদ করলে বাবা কষ্ট পাবে! আর তখন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। একবার একটা পাজামার জন্য বাবাকে কষ্ট দিয়েছি। এমন জিদ করেছি, নতুন পাজামা না পেলে নামাজ পড়তেই যাব না। বাবা সেই ভোর রাতে তিন মাইল দূরে থেকে পাজামা বানিয়ে এনে দিয়েছিল। আজ আমার অনেক পাজামা, শুধু বাবা নেই!' সাফিয়া খন্দকার রেখা (সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত) \হ 'জন্ম থেকে ১৬ বছর বয়স অব্দি অনেক মানুষের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। বাবা চাচারা তিন ভাই, তাদের তিন জনার ১২ জন ছেলেমেয়ে; ছোট ফুপি দুজন ঘরে, সাহায্য করার লোক মিলে ২০/২১ জনের বিশাল সংসারে বেড়ে ওঠা আমার। ছেলে বেলায় চাঁদরাতে ঘুমাতাম না, সকালের পরিকল্পনা করতেই পার হয়ে যেত রাত। কার আগে কে গোসল করে নতুন জামা জুতো পরে সবাইকে সালাম করতে পারে এটি নিয়েও চলতো গোপন প্রতিযোগিতা। সালামি রাখার জন্য তখন ভ্যানিটি ব্যাগ থাকা চাই-ই চাই। দুপুর হতেই জামা চেঞ্জ; মামা বাড়ির দেয়া জামা, কার ড্রেস কেমন এ নিয়ে বন্ধু মহলে গবেষণা। মহলস্নায় সব বাসায় যাওয়া। আলেয়া আরমিন আলো (গৃহিণী + লেখক) 'ঈদের আনন্দ শুরু হতো রমজানের শুরু থেকেই। নতুন কাপড় কবে আনবে বাবা, তা কৌশলে লুকিয়ে রাখা। চাঁদ রাতে দল বেঁধে বিকেল থেকেই আকাশে ঈদের চাঁদ খুঁজে বেড়াতাম। এই রাত যেন শেষ হতেই চাইতো না। ঈদের দিন খুব সকালে আমাদের ডেকে তোলা হতো। সবাই গোসল করে নতুন জামা জুতো পরতাম। বাড়ির ছোট বড় সব ছেলে নতুন পাঞ্জাবি পরে সেমাই খেয়ে মিষ্টিমুখ করে বাবা আর চাচার হাত ধরে ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহে যেতাম। শৈশবে আমিও বহুবার বায়না ধরে বাবার সঙ্গে ঈদগাহে গিয়েছিলাম। কারণ ঈদগাহের রাস্তার ওপর তখন ছোটখাটো মেলা জমতো। মাটির হাঁড়ি পাতিল, পতুল খেলনা নিয়ে ফেরিওয়ালার দল বসে থাকতো। বাবাও আমাদের আবদার মেটাতে নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে এগুলো কিনে দিতেন। ঈদের দিনের প্রধান আকর্ষণ ছিল মুরুব্বিদের কদমবুসি করে ঈদের সালামি নেয়া। যা তখন আমাদের শিশু মনের ঈদ আনন্দের মূল উৎস ছিল। সাজগোজ শেষে প্রথমেই দাদিকে সালাম করতাম। তারপর, বাড়ির মুরুব্বি ছাড়াও পাড়া প্রতিবেশী মুরুব্বিদের সালাম করতাম। কেউ সালামি দিতো, কেউ আবার মাথায় হাত রেখে দীর্ঘ দোয়া করে দিত। মা আর চাচি মিলে সবাইকে পিঠা পায়েস আর সেমাই দিয়ে আপ্যায়ন করাতো।