বেদে সম্প্রদায়ের নারীদের বিচিত্র জীবন

প্রকাশ | ১০ জুন ২০১৯, ০০:০০

জাবেদ মজুমদার
টেকেরহাটের ঐতিহ্যবাহী কুমার নদীর তীরে ছোট ছোট পলিথিন মোড়ানো সারিবদ্ধভাবে সাজানো ঘরগুলো দেখলেই বোঝা যায় বেদেরা সাময়িকভাবে অবস্থান নিয়েছে। নদীর সঙ্গে তাদের জীবনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ছোট ছোট সাজানো নৌকায় ওদের ঘরবাড়ি। স্রোতে শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়ানো বেদেদের জন্ম-মৃতু্য, বিয়ে-শাদি, সামাজিক অনুষ্ঠান নৌকায়ই হয়। এদের কোনো নির্দিষ্ট এলাকা নেই। দলবদ্ধভাবে জীবিকার তাগিদেই। যখন যেদিকে প্রয়োজন সেদিকেই তাদের নৌকা এগিয়ে যায়। কেউ জানেও না এরা কোথা থেকে এলো? কোথায় গেল? এ সম্প্রদায়ের মেয়েরা উপার্জন করে, ছেলেরা ঘরকন্না সামলায়, ফূর্তি করে বেড়ায়। বেদে মেয়েরা ভীষণ কর্মঠ ও পরিশ্রমী হয়। কাকডাকা ভোরে শিশু নিয়ে মনিহারি দ্রব্য বা সাপের ঝাঁপি নিয়ে বের হয় তারা। সারাদিন গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দিনের শেষে ক্লান্ত দেহে ফেরে আস্তানায়। বেদেনিরা যখন গ্রামে গ্রামে পণ্য বিক্রির জন্য পরিভ্রমণ করতে যায়, তখন বেদেরা নৌকা পাহারা দেয়। বেদেরা কেবল জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে থাকে এবং নিজেরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। শৌখিন বেদেরা কেউ কেউ নানা ডিজাইনের নৌকা তৈরি করে থাকে। এ সবের মধ্যে রয়েছে ময়ূরপঙ্খী নৌকা। বেদে মেয়েদের আরেকটি বৃহৎ আয়ের উৎস ঝিনুক কুড়ানো। নদীতে অনেক ছোট-বড় ঝিনুক থাকে। স্তূপীকৃত ঝিনুক বিক্রি করে তারা অনেক টাকা আয় করে। আবার ঝিনুকের ভেতরের মুক্তা বিক্রি করে তারা বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করে। ঝিনুক দিয়ে বোতাম, মেয়েদের কানের দুল, চুলের ব্যান্ডসহ বিভিন্ন গয়না তৈরি করা হয়। শিল্পীরা এতে রঙ তুলি এঁকে অপূর্ব বিষয়বস্তু করে তোলে। বৈদ্যরা সাধারণত সুশ্রী। এদের পুরুষরা কবিরাজী করে। সাপের খেলা দেখায়। সাপের কামড়ের চিকিৎসা করে তাবিজ বিক্রি করে। স্ত্রীরাও এদের মতো জীবিকার অন্বেষণে গ্রামে ঘুরে সাপের খেলা দেখায় সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করে। তাবিজও বিক্রি করে সান্দা জাতের বেদেরা শ্রেণিভুক্ত। এদের মেয়েরা বেশি সাজগোছ করে ও সাধারণত চুড়ি বিক্রি করে। শহর ও গ্রামে এদের যাতায়াত বেশি। এরা হিসাব-নিকাশ ভালো বোঝে এবং কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতায় থাকে। বৈরাগী শ্রেণির মেয়েরাও সারারাত জেগে বিভিন্ন উপায়ে মাছ ধরে পরদিন তা বাজারে বিক্রি করে এরা সারাক্ষণ নৌকায় থাকে। বেদেদের এ যাযাবর জীবনে এখনো সর্দারের অনুমোদন ছাড়া নতুন নৌকা তৈরি, ছেলেমেয়েদের নাম রাখা এবং বিয়ে ও যাত্রার স্থান নির্বাচন কল্পনাই করা যায় না। সর্দারের আদেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বিচারের ক্ষেত্রে সর্দারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত। যাযাবর বেদেদের নৌকার সংসার ক্রমেই ডাঙার মাটিতে স্থানান্তর হচ্ছে। বেদে বংশধররা তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনধারার কথা ভুলে যেতে বসেছে। জন্ম-জন্মান্তর ধরে পানির স্রোতে ভেসে বেড়ানো বেদে সম্প্রদায়ের উত্থানের ইতিহাস কারও জানা নেই। শুকিয়ে যাওয়া নদীর স্থান পরিবর্তন করে বেদেরা অপেক্ষাকৃত বড় নদীতে নৌকার বহর গড়ে তোলে। সামাজিক কর্মকান্ড ব্যাপক দেশ-গ্রামে গেলে তখন আর বেদে বহর যত্রতত্র বড় একটা চোখে পড়ে না। বেদেদের এখনো চরম দুঃসময়। জাত-পেশা ছেড়ে অনেকেই উঠে এসেছে স্থলে। ঝাঁপি মাথায় বেদেনিদের সারিবদ্ধ লাইন আর তেমন চোখে পড়ে না। ক্রমেই তারা বেছে নিচ্ছে অন্য পেশা। বর্তমানে কঠিন জীবন-জীবিকার পথে এরা আর তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে পারছে না। তাই অনেকেই পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে এরা বেছে নিচ্ছে অন্য পেশা। এদের সামাজিক মর্যাদা দেয়া আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।