শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট আনল খুলনার মেয়েরা

প্রকাশ | ১৭ জুন ২০১৯, ০০:০০ | আপডেট: ১৭ জুন ২০১৯, ১১:২০

তানিয়া তন্বী
'জাতীয় বিজ্ঞান বিতর্ক উৎসব-২০১৯' প্রতিযোগিতায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করছে বিজয়ী দল
প্রথম আষাঢ়ের শেষ বিকেলের আকাশটা ছিল মেঘে ঢাকা। মাঝে মধ্যে বইছিল ঠান্ডা হাওয়া। তবে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ মিলনায়তনের চিত্রটা ছিল ভিন্ন। সেখানে ছড়াচ্ছিল উত্তাপ। যুক্তির শানিত তীর ছুড়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার তীব্র প্রতিযোগিতায় মেতেছিল খুলনার সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও নওগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় দলের বিতার্কিকরা। তত্ত্ব আর তথ্যের সন্নিবেশে প্রতিপক্ষকে কাবু করার অদম্য প্রচেষ্টায় উত্তেজনা ছড়িয়েছিল অভ্যাগত অতিথি ও দর্শকদের মধ্যেও। 'সর্বস্তরে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব' শীর্ষক প্রস্তাবের পক্ষে এবং বিপক্ষে দলগুলোর যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির রসাস্বাদনে মুগ্ধ দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালিতে পুরো মিলনায়তনে তখন তীব্র উত্তেজনা। মঞ্চের সামনে বসা বিশিষ্টজনের হাতগুলোও বারবার তালিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল। নতুন প্রজন্মের মধ্য দিয়েই তারা দেখছিলেন আগামী দিনের যুক্তিনির্ভর, গণতান্ত্রিক, মননশীল ও সৃজনশীল জাতি গড়ে ওঠার প্রচেষ্টা। শেষ দিনের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ বিতর্ক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই পর্দা নামল বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বিএফএফ)-সমকাল আয়োজিত 'জাতীয় বিজ্ঞান বিতর্ক উৎসব-২০১৯'-এর চূড়ান্ত আসরের। এবার সারাদেশের ৬৪টি জেলার ৯টি অঞ্চলের ৫২০টি স্কুলের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে খুলনার সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় দলের বিতার্কিকরা। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, বিতর্ক আমাদের সাহসী করে, আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলে। ভাষার ব্যবহার ও এর ওপরে তার্কিকের দখল বাড়ে। বিতার্কিকরা তাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারে। তিনি বলেন, বিতর্ক একটি শিল্প। এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী পরমতসহিষ্ণু হিসেবে গড়ে ওঠে। ভাষার বহুমাত্রিক ব্যবহার দিয়ে মানুষের মাঝে প্রভাব তৈরি করতে পারে। তাই বিতর্ক চর্চার উদ্যোগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোরালো করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিতর্কের জন্য একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। একইসঙ্গে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার কথাও বলেন তিনি। নিজের স্মৃতিচারণ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিতার্কিকদের বক্তব্য শুনে তার বিতর্ক জীবনের স্মৃতি নাড়া দিয়েছে। তবে আজকের প্রজন্মই যে সেরা, সেটা তারা তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতে সরকার উদ্যোগী হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে তার উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষা সেদিকে নিয়ে যাবে। এ জন্য সরকার বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, বিজ্ঞানে না পড়েও বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যায়। বিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু বিজ্ঞানী তৈরি করা নয়, এর মাধ্যমে কুসংস্কার দূর হয়ে আলোকিত সমাজ তৈরি হবে। বিতার্কিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'তোমাদের হাতেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। আগামীর বিশ্বে দেশকে নেতৃত্বের আসনে তোমরাই বসাবে। যেখানেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন কর না কেন, তোমার বুকের মধ্যে থাকবে বাংলাদেশ।' বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সেন্ট্রাল উইমেন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান বলেন, তিনি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন না। তবুও দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। প্রশ্নের মাধ্যমে নিজেকে জানার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, বিজ্ঞান হলো বোঝার বিষয়। বুঝতে হলে সঠিক প্রশ্ন করা শিখতে হবে। প্রযুক্তি যেমন মানবকল্যাণের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে, তেমনি এর মাধ্যমে ধোঁকাবাজি-দুর্নীতিও সহজ হয়েছে। কথাপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে উদ্যমী তারুণ্যের অভাব নেই। তাদের তৃণমূল থেকে বের করে নিয়ে আসা জরুরি। বিএফএফের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী বলেন, বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্যে অনেক কর্মসূচির মধ্যে একটি হলো বিজ্ঞান বিতর্ক উৎসব। বিজ্ঞানভীতি দূর করে কীভাবে বিজ্ঞানকে আরও জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় করা যায়, সেদিকেও তাদের লক্ষ্য রয়েছে। স্বাগত বক্তব্যে সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ বলেন, বিজ্ঞান মানেই যুক্তির যাত্রা। সে অর্থে সবকিছুর মধ্যে বিজ্ঞান আছে। বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব। সমকালের সহকারী সম্পাদক ও সুহৃদ সমাবেশের বিভাগীয় সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। বিতর্ক পর্বের মডারেটর হিসেবে ছিলেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক হাসান জাকির। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট ডিন অধ্যাপক ফারহানা হেলাল মেহতাব ও ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের উপাধ্যক্ষ এম নূরুন নবী। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে ছিলেন সাবেক কৃতী বিতার্কিক রাশেদুল ইসলাম পলস্নব, দেবাশীষ রঞ্জন সরকার, আব্দুলস্নাহ চৌধুরী মামুন, নিশাত সুলতানা ও মোহাম্মদ আব্দুল মাজেদ। পরে অনুষ্ঠানের বিজয়ী ও রানার্স আপ দলগুলোর মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে ট্রফি জিতে নেয় খুলনার সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় দল। প্রথম রানার্স আপ নওগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় দল ও দ্বিতীয় রানার্স আপ হয়েছে যুগ্মভাবে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ দল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় দল। শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে বিজয়ী হয়েছে খুলনার সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় দলের দলনেতা ফাওজিয়া ফারিয়া জেবা। দ্বিতীয় রানার্স আপ দলের তার্কিকরা প্রত্যেকে একটি স্মার্টফোন, ক্রেস্ট, বই ও সনদপত্র পেয়েছে। প্রথম রানার্স আপ দলের সদস্যরা পেয়েছে প্রত্যেকে একটি করে ল্যাপটপ, ক্রেস্ট, সনদপত্র, বই ও রানার্স আপ দলের ফলক। চ্যাম্পিয়ন দল জিতেছে প্রত্যেকে একটি করে ল্যাপটপ, চ্যাম্পিয়ন দলের ফলক, ক্রেস্ট, বই আর সনদপত্র।