মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে চাকরিতে ফেরা

বাংলাদেশে চাকরির ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় এখনো অনেক কম। চাকরিজীবন শুরু করলেও অনেক সময় দেখা যায় মধ্যপথেই সেই কাঙ্ক্ষিত চাকরি নারীকে ছেড়ে দিতে হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের দেশে সন্তান জন্মানোর পর চাকরি ছেড়ে দেয়া নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। সন্তানকে দেখাশোনার লোক বা ডে কেয়ারের অভাব, নানা পারিবারিক-সামাজিক চাপের পেছনে অন্যতম কারণ। সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতামূলক আচরণই পারে চাকরি থেকে অকালে ঝরে পড়া নারীর সংখ্যা কমাতে। সন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে প্রতিটি নারীর শুরু হয় এক নতুন জীবন। মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে চাকরিতে যোগদান, সন্তান দেখাশোনা, সংসার সামলানো একইসঙ্গে এসব দায়িত্ব পালন প্রতিটি মায়ের জন্য হয়ে পড়ে খুবই কঠিন। ছুটি শেষে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে সম্মুখীন হতে হয় নানা বাধার- তেমনি সন্তানকে ফেলে চাকরি করায় ভুগতে হয় আত্মযন্ত্রণায়। এই কঠিন সময় পার করতে নারীর কী করণীয় জানতে কথা হচ্ছিল দুই চাকরিজীবী নারীর সঙ্গে...

প্রকাশ | ২৪ জুন ২০১৯, ০০:০০ | আপডেট: ২৪ জুন ২০১৯, ১৩:১৩

অনলাইন ডেস্ক
ফারিয়া আক্তার প্রাইভেট ব্যাংকে আছেন। তিনি বলেন, আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে, আমি ছয়মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছি। আগে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতে নারীদের চলিস্নশ দিন পরেই যোগ দিতে হতো। এ জন্য চলিস্নশ দিন পরেই সন্তানকে বাইরের দুধ দিতে হতো। এ সময় অনেকেই তাই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো। তেমনি ছয়মাস ছুটি শেষে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে, আমার পক্ষে এই চাকরি করে যাওয়া সম্ভব নয়। এখনও আমি যে চাকরি করছি এর পেছনে আমাকে কি পরিমাণ সংগ্রাম করতে হয়েছে নিজের সঙ্গে, অফিসের সঙ্গে ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তা বলে বুঝাতে পারব না। এ সময় আমার একই সঙ্গে প্রমাণ করতে হয়েছে যে, সন্তানের কারণে আমার কাজে কোনো ঘাটতি হচ্ছে না আবার আমি চাকরি করছি দেখে আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। অফিসে যোগদানের পরে সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রথমেই শুনতে হয়েছে "আপনাদের তো মজা, ছয় মাস কাজ না করেই বেতন পেলেন"। এ সময় প্রতিটি নারী জীবন মৃতু্যর সঙ্গে যুদ্ধ করে সন্তান জন্মদান করে। প্রায় সম্পূর্ণ সময় সন্তানের সঙ্গে রাত জেগে কাটাতে হয় কিছুক্ষণ পর পর খাওয়াতে হয়। সন্তানকে দেখাশোনা করতে গিয়ে সম্পূর্ণ ঘরে বন্দি থাকতে হয়। তবু শুনতে হয় ছয়মাস আনন্দে ছুটি কাটিয়েছি। এখন ডাক্তাররা বলে সন্তানকে একবছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াতে। চাকরি শুরু করার পর আমি যে দুপুরে এসে সন্তানকে খাইয়ে যাব তার উপায়ও ছিল না। শুনতে হতো আমি ফাঁকি দিচ্ছি। অন্যদিকে বাসায় শুনতে হয়েছে, তোমার এই চাকরির জন্য বাচ্চা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রথম যেদিন অফিসে যোগ দিয়েছি মনে হয়েছে বাচ্চাকে ফেলে আমার পক্ষে অফিসে থাকা সম্ভব না। সে সময় মানসিক সাহসের দরকার ছিল তার পরিবর্তে পরিবারের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে, আমাকে না পেয়ে সন্তান কত কেঁদেছে, খুঁজেছে। মনে হয়েছে মা হিসেবে আমি অন্যায় করছি। এখন আমার মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। অফিস শেষে বাড়ি ফিরলে আমাদের গল্প, পড়াশোনা শুরু হয়। আমাকে চাকরির ব্যাপারে আমার মেয়েই উৎসাহ দিচ্ছে। আমাকে কম সময় পাচ্ছে বলে তার কোনো অভিযোগ নেই। আমি সেই সময় সব বাধার মুখে চাকরি করে গেছি বলে আজকে এই অবস্থানে আসতে পেরেছি- তবে অনেকেই হয়তো পারবে না। সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নারীদের চাকরিজীবনকে অনেক সহজ করে দিতে পারে। আমি যখন মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে প্রথম অফিসে ঢুকি মনে হচ্ছিল আমি নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত। আমার সিটে আরেকজন বসে কাজ করছে। আমি যে কোথায় বসব বা কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মানুষের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল আমি কোনো অপরাধ করে এসেছি। এতদিন ছুটি কাটিয়ে কেন আবার অফিস করতে চাচ্ছি। অন্যদিকে আমার ছেলেকে তার নানির কাছে রেখে এসেছি। সারাক্ষণই আমার মনে হচ্ছে এই বুঝি ও কাঁদছে। এভাবেই নিজের মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে তার প্রথম অফিসে যোগদানের গল্প বলছিলেন নীলা। তিনি বলেন, আমাদের এখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে পুনরায় কাজে ফেরা এক যুদ্ধ। এখানে সহকর্মীদের কাছ থেকে সহযোগিতা খুব কমই পাওয়া যায়। প্রথম কাজ শুরু করে মনে হয়, কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই। নিজের সেই কর্মপরিবেশ আবার ফিরে পাওয়া বেশ কঠিন। আমার এই ছুটিকে দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হয়। কর্মজীবনে অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাই একটি খারাপ প্রভাব পড়ে। ধরেই নেয়া হয় আমার পক্ষে আগের মতো কাজ করা সম্ভব নয়। যেটি কখনই সত্য নয়। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন খুবই প্রয়োজন। আমার ছেলের দাদা-দাদি, নানা-নানি সবাই থাকে গ্রামের বাড়িতে। আমার অফিস মতিঝিলে ছিল। মতিঝিলে এত অফিস কিন্তু ডে- কেয়ার সেন্টার অপ্রতুল। একটি দুটি অফিসে ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা রয়েছে। আমার অফিসে কোনো ডে- কেয়ার সেন্টার ছিল না। আমার মায়ের পক্ষে কতদিন নিজ বাড়িঘর ফেলে নাতিকে দেখা সম্ভব। তাই দেখাশোনার লোকের অভাব এবং একই সঙ্গে চাকরির বৈরী পরিবেশের কারণে তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। আজকে বাচ্চা রাখার ডে- কেয়ার সেন্টার থাকলে আমার জীবনে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। জানি না, ভবিষ্যতে আবার চাকরি করতে পারব কি না, তবে চেষ্টা করব। নন্দিনী ডেস্ক