স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা পাক প্রতিটি নিঃসঙ্গ মা

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

রুমানা নাওয়ার
মা- এ একটি শব্দে কি অপূর্ব মাদকতা। সমস্ত দেহ মনে শান্তির পরশ মাখানো একটা ডাক, একটা শব্দ। সৃষ্টির তাবৎ ভাষার মাঝে এ একটি ভাষাই সেরা আমার কাছে। সমস্ত মায়া সমস্ত ভালোবাসার আঁধার এ ডাকে। বিধাতা এক আশ্চর্য মায়াময় রূপে পাঠিয়েছেন তার সৃষ্টির এ চরিত্রকে। প্রতিটা মা যেন একই। তাদের চলন বলন সন্তানে মায়া ভালোবাসা সব একই। সেটা শহুরে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মা হোক অথবা গাঁয়ের সে আটপৌড়ে মা। ফল্গুধারায় নিরন্তর ভালোবাসা দেয়া মাদের একমাত্র কাজ। সব মা এক না। কিছু কিছু মা একেবারে আলাদা। একাই বয়ে নিয়ে চলে সন্তানসহ নিজের সমস্ত দেখভাল। পুরুষটি যখন নির্ভরতার আশ্রয় না হয়ে দুর্বিষহ করে তুলে চারপাশ। তখন একা একা দিন যাপনে আগ্রহী হয়। সন্তানের বোঝা কাঁধে নিয়ে সামনে এগোয় মা নামের এসব নারীরা। কতটা ত্যাগ আর তিতিক্ষা তাদের তা কেবল ওরাই জানে। নানা মুখের নানা কথা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে এরা। ভালোর চেয়ে মন্দের ভাগ বেশি দেয় আমাদের সমাজ এদের। দ্বৈতস্বত্বা নিয়ে এদের বিচরণ- সমাজে, সংসারে ও সন্তানের কাছে। এরা বাবা এবং মার ভূমিকা পালন করতে করতে জীবন শেষ করে দেয়। নিজের কথা ভাবার সময়ই পায় না। নিজের বাকি জীবনটা সন্তানের মুখ চেয়ে কাটিয়ে দেয়ার পণ করা এসব মায়েরা দ্বিতীয় কোনো জীবনে জড়ায় না। সুখের শখের সব লেনাদেনা যেন চুকে ফেলে ভেঙে যাওয়া প্রথম সংসারের মতোন। তিলতিল করে মানুষ করার নেশায় ব্রতী হয় সন্তানকে। সন্তান মানুষ হয়। শিক্ষায় আলোকিত হয়। মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে। কিন্তু মা তার পেছনের দিনের সময়গুলোকে বেমালুম ভুলে যায়। মায়ের কত ত্যাগ, কত তিতিক্ষা তাকে ঘিরে। সমাজ নামক নিষ্ঠুর ব্যবস্থার কত উপহাস তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের জবাব তাকে দিতে হয়েছিল প্রতিনিয়ত। তা নিমেষে ভুলে যায়। ভুলে যায় রাতের পর রাত তাকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় রাত পোহানোর কথা। মাকে দোষারোপ করে ক্ষেত্র বিশেষে। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হওয়ার গস্নানিতে মাকে দোষিত করে। যত অপূর্ণতার খেসারত যেন মাকেই দিয়ে বাঁচতে চায়। বাবা নামক ব্যক্তিটি যে তার বা তার মায়ের দায়ভার না নিয়ে অন্য ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছিল। তা বুঝতে পেরেও ভুল দোষে দোষারোপ করে মমতাময়ী মাকে। নানা জায়গায় নানাভাবে হেনস্তা হতে হয় এসব মায়েদের। প্রশ্ন বানে জর্জরিত হতে হয়। সংসার কেন টিকলো না? সমস্যা কার ছিল? একটু মেনে নিলে ক্ষতি কি ছিল? ওরকম চরিত্রের দোষ ছেলেদের মধ্যে একটু একটু থাকে। তাই বলে সংসার ফেলে চলে আসা উচিত হয়নি। এ রকম হাজারো কথায় বিপর্যস্ত হয় খুকি আপার। দু দুটো ছেলে সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিল উনার। স্বামী ভালো চাকুরে।খুকি আপাও জব করে ভালো বেতনের। বাসায় কাজের মেয়ে ছেলেদের দেখাশুনো করে। হঠাৎ একদিন শরীর খারাপ হওয়ায় অফিস থেকে আগেভাগে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসে। ছেলেরা তখনও স্কুলে। বাসায় ঢুকে খুকি আপার চক্ষু চড়কগাছ। একি দেখলেন উনি। এও কি সম্ভব? কাজের মেয়েকে নিয়ে তার পতি দেবতা বিছানায় অনৈতিক কাজে লিপ্ত। এ দৃশ্য দেখার পর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না উনি। বরকে কোনো কথা বলার সুযোগই দিল না। দুসন্তানকে স্কুল থেকে নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করল। এবং তারপর ডিভোর্স। ভুলের জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করল। ক্ষমা চাইল বারবার লোকটা। খুকি আপা টলেনি। অনেক বুঝাল সবাই। পুরুষ মানুষতো। মাফ করে দাও। তবুও নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন তিনি। উনার একটাই কথা --- ওই লোকটার সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকা অসম্ভব।ওরকম একটা জানোয়ারের সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। এরপর থেকে আজ আটাশ বছর খুকি আপা একা। একা একাই দুসন্তানকে বড় করেছেন, মানুষ করেছেন। সুন্দর আগামী তার সন্তানের মাঝে খুঁজে বেড়ান। সুখ খুঁজে বেড়ান সন্তানের পরিপূর্ণতায়। নিজে কি পেলেন না পেলেন ভাবেন না অতশত। ছেলেরা তার না পাওয়ার সব কষ্টের ঋণ শোধ করবে একদিন এ আশায় দিনাতিপাত। খুকি আপার মতো আরো কতশত নারী স্বামীর সংসার ছেড়ে একা একা দিনযাপন করছে। তার খবর কি আমরা রাখি। কতটা দুঃখ পাষাণে বেঁধে এরা জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যায় তা কেবল ওসব নারীই জানে। সমালোচনা না করে সমব্যথী হোন প্রতিটি সিঙ্গেল মায়ের কাজে। ভাগীদার হোন তাদের দুঃখেও। স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা পাক প্রতিটা নিঃসঙ্গ মা। কানাঘুষোয় বিপর্যস্ত না হোক একাকী থাকা মা'র জীবন। নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে একা একা জীবনের ভার বয়ে চলা এসব মা সবার জন্য স্যালুট। কারো ওপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্যায় আচরণকে তীব্র ঘৃণায় পায়ে দলে একা একা দিনযাপন করা ত্যাগী এসব মাদের বুক ভরা ভালোবাসা। সন্তানকে আঁকড়ে ধরে জীবনের দূরগামী পথ পাড়ি দেয়া এসব মায়েদের জানাই শ্রদ্ধা। আসুন ভালোবাসি এসব মায়ের শ্রমকে। দাম দিই তাদের প্রতিটি মুহূর্তের। তাদের দুঃখের সময়টাকে আনন্দের ফোয়ারায় ভাসিয়ে তুলি। প্রতিটি সন্তান হোক মায়ের সন্তান। হোক দুঃখের দিনের সমব্যথী।