সুরক্ষিত থাক কন্যার শৈশব কৈশোর

আমাদের দেশে হাজার হাজার নারী কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার অভিযোগে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেন শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব নির্বিশেষে আমাদের সমাজে এমনকি নিজেদের পরিবারেও আমরা লক্ষ্য করে থাকি, কন্যাশিশুর প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণ

প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ছবি : অনন্যা ও আসমা শোভা
সোরিয়া রওনক বতর্মানে আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজব্যবস্থায় আমরা কথায় কথায় বলি, 'সন্তান ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, মানুষ হওয়াটাই আসল কথা।' কিন্তু অনেকেই মৌখিকভাবে তা মানলেও মনে মনে ঠিকই চিন্তা করেন 'সন্তান হতে হবে ছেলে'। কন্যাসন্তান হওয়ার ক্ষেত্রে একজন নারীর কোনো ভূমিকা নেই- এই প্রমাণিত সত্যটি শিক্ষিত পুরুষ জানার পরও মানসিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এ দায় চাপিয়ে দেন নারীর ওপরই। ফলে কোনো অন্যায় না করে আমাদের দেশে হাজার হাজার নারী কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার অভিযোগে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেন শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব নির্বিশেষে আমাদের সমাজে এমনকি নিজেদের পরিবারেও আমরা লক্ষ্য করে থাকি, কন্যাশিশুর প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণ। ফলে অনেকাংশেই দারিদ্র্যের প্রথম শিকার হয় আমাদের কন্যাশিশুরা। কিছু সামাজিক কথিত নীতির ফলে শিশুকাল থেকেই কন্যাশিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যেন তারা আগামীর কিছু হতে না শেখে। তাদের প্রতি করা বৈষম্যমূলক আচরণকে অন্যায় হিসেবে না দেখে সহজাত ও সমঝোতার সঙ্গে গ্রহণ করতে শেখানো হয়। যা পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি নিযার্তন ও সহিংসতার পথটিকে প্রশস্ত করতে সাহায্য করে। শিশু মৃতু্যহার, অপুষ্টি এসব বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নতি করলেও শিশুর সুরক্ষা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। কিন্তু এখনো কন্যাশিশুদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিনিয়তই কন্যাশিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশে প্রচলিত কুসংস্কার, সামাজিক অসচেতনতা, অশিক্ষা, ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব প্রভৃতি কারণে ছেলে শিশুদের তুলনায় কন্যাশিশুরা নানা দিক দিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে নিম্নবিত্ত কোথাও নিরাপদে নেই কন্যাশিশুরা। একটি কন্যাশিশু তার পরিবারের ভেতরেই প্রথম আপত্তিকর স্পর্শ, আচরণ, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে পরিবারেও নিরাপদ নয়। আমরা শিশুদের নিরাপদ পরিবেশ দিতে পারছি না। এর কারণ হচ্ছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ একটি কন্যাশিশুকে আমরা শিশু হিসেবে দেখছি না। দেখছি মেয়ে হিসেবে। আমাদের পরিবারে যখন দুটি শিশুর জন্ম হয়, সেই শিশু দুটির ওজন, চেহারা, ভিন্নতা এবং তাদের শক্তি, চিন্তা, কান্না, হাসি কোনো কিছুই পার্থক্য থাকে না; কিন্তু দেখা যায়, সেই শিশুটি যখন আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে তার আশপাশের যে পরিবেশ, পরিবার, সমাজ আস্তে আস্তে মনে করিয়ে দেয় যে তুমি কন্যাশিশু, তোমার জন্য একটি নির্দিষ্ট এরিয়া আছে এবং তুমি জোরে হাসতে পারবে না, জোরে কাঁদতে পারবে না, তোমার চাহিদার একটা সীমানা থাকবে। কিন্তু ছেলে শিশুটিকে অবাধ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় এবং তাকে তার যত ধরনের বিনোদন বা তার উচ্ছলতা প্রকাশ করার সুযোগ, তার চলাফেরা বা তার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার সুযোগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সীমা নির্ধারণ করা হয় না। এ ছাড়া খাবার-দাবারের বৈষম্যের কারণে পুষ্টির দিক থেকে মেয়েশিশুটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে থাকে। যখন একটি কন্যাশিশু গর্ভে থাকে তখনো যদি আলট্রাসনোগ্রাফ বা অন্য কোনো মাধ্যমে জানতে পারা যায় যে কন্যাশিশু জন্ম হবে সেই ক্ষেত্রে মায়ের ওপর কন্যাশিশুর ভ্রূণ অবস্থা থেকেই নির্যাতন শুরু হয় এবং কন্যাশিশুটির যখন জন্ম হয় তখন তাদের যে স্বাগত জানানো হয় সেই একটি পুত্রশিশুকে যেভাবে স্বাগত জানানো হয় সে ক্ষেত্রে কন্যাশিশুকে সেভাবে জানানো হয় না। পুত্রশিশুকে জাঁকজমকভাবে এবং কন্যাশিশুকে অনাড়ম্বরভাবে স্বাগত জানানো হয়। সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা এবং পরিবারের এই চর্চা এর মধ্যদিয়ে আস্তে আস্তে কন্যাশিশুর মানসিকতা সংকুচিত হয়, শারীরিকভাবে দুর্বল হয় এবং তার চলাফেরা ও তাকে গড়ে তোলার সুযোগ সীমিত হওয়ার কারণে আস্তে আস্তে পুত্র এবং কন্যার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় ফলে পুত্র হয়ে ওঠেন শক্তিশালী, পরাক্রমশালী ও কন্যা অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রকৃতির। পুত্রশিশুর চলাফেরা গন্ডি অনেক বড় হওয়ার কারণে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। কন্যাশিশুর সেই ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে থাকে এর মাধ্যমে পুত্র-কন্যা বা ছেলেমেয়ের মধ্যে পার্থক্য শুরু হয়। পরে সংসারজীবনে সবই আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি মেয়ে যখন জন্ম হলো সেসবকে ভালো রাখার জন্য, সবকে খুশি রাখার জন্য বা সবাইকে সেবা-শুশ্রূষা করবে, সে সহযোগী হিসেবে কাজ করবে এবং পুত্র সে নেতৃত্ব করবে সংসারের হাল ধরবে, সম্পত্তি রক্ষা করবে এবং শেষ বয়সে বাবা-মাকে দেখবে কিন্তু বাস্তবে আজ তার উল্টো চিত্রও দেখতে পাই এখন মেয়েরা উপার্জন করছে, সংসার পরিচালনায় অর্থের জোগান দিচ্ছে, বাবা-মায়ের ভরণপোষণসহ নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করেছে। এই যে বৈষম্য পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে তৈরি হয় এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারী ভোগের বস্তু, নারী একটু দুর্বল, নারী মমতাময়ী এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে কন্যা এবং পুত্রশিশুরাও, তাদের মধ্যেও এই মানসিকতা আস্তে আস্তে দৃঢ় হতে থাকে, কন্যাশিশুটির মধ্যেও দুর্বলতা আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দেয়া হয় এবং মেয়েটিকে অর্ধেক ও দুর্বল মানুষে পরিণত করে। পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩১ লাখ কন্যাশিশু অসহায়ত্বের শিকার। এদের এখান থেকে উঠিয়ে না আনতে পারলে দেশের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হবে না। সরকারি ও বেসরকারি সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রায় ৮১ লাখ কন্যাশিশু হতদরিদ্র। এর মূল কারণ পারিবারিক দরিদ্রতা। শহরের চেয়ে গ্রামের অবস্থা বেশি খারাপ। ঠিকমতো খাবার না পেয়ে অনেকেই শিকার হচ্ছে নানান রোগব্যাধির। রোগশোকে ধুকে অনেকেই মৃতু্যমুখেও পতিত হয়। ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় লাখ লাখ শিশু রাত কাটায়। এদের পথশিশু বলা হয়ে থাকে। কন্যাশিশুরা একটু বড় হলেই নানা লালসার শিকার হতে থাকে। অনেকে না জেনেই বা বাধ্য হয়ে পতিতাবৃত্তির মতো জঘন্যতম বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। যা সমাজের একটি দুষ্টক্ষত। এ ক্ষত দূর করা যাচ্ছে না কিছুতেই। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। পাঁচ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে শিশুরা আর্থিক টানাপড়েন ও অসহায়ত্বের কারণে হোটেল-রেস্তোরাঁ, বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন আশ্রমে কাজ করে। এসব স্থানে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই মালিক বা মালিকপক্ষের লোকের মাধ্যমে নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হয়। অনেক সময় গৃহিণীরা ঠিকমতো খাবার, পোশাক, চিকিৎসা ইত্যাদি সুবিধা দেয় খুবই কম। নানা অভিযোগে দেয়া হয় গরম খুন্তির ছঁ্যাকা। মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় এসব ন্যক্কারজনক খবর ছাপা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় গৃকর্ত্রীকে। তারপরও এসব কমছে না। কেননা, আইনের শাসন বর্তমানে নেই বললেই চলে। কন্যাশিশুদের আরেকটি বড় বিপদ রয়েছে। সেটি হলো বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সমাজ আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। এমনকি এখন বাল্যবিবাহের ঝুঁকির ভেতর রয়েছে এমন অল্পবয়সী মেয়ে কেউ কেউ নিজের বিয়ে নিজেই ঠেকিয়ে দিচ্ছে- সমাজে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। তারপরও দেশ থেকে এই রীতি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাল্যবিবাহ যাদের ঠেকানোর কথা বহু এলাকায় তারাই এর মদদদাতা হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। জন্মসনদ থাকলে কাজি, আইনজীবী সবাই বিয়ে পড়ানোয় দ্বিধা করেন না। সন্দেহ হলেও প্রশ্ন না তোলার প্রবণতা বেশি, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। এ ধরনের সমস্যায় বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া জন্মসনদ দেয়া বন্ধ করতে হবে। সমাজবিজ্ঞানের গভীর পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, বাল্যবিবাহ কোনো পৃথক সমস্যা নয়। একে দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে অন্য সব সামাজিক সমস্যার অংশ হিসেবে। দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা, মিডিয়ার দ্বারা নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন, পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্ট সামাজিক ব্যাধি, নারী পাচার, মাদক ব্যবসা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এ সব কিছুই দায়ী বাল্যবিবাহের জন্য। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান না করে শুধু বাল্যবিবাহ বন্ধ করা এক অসম্ভব ব্যাপার বলেই মনে হয়। বরং গ্রামবাংলায় মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বাল্যবিবাহের হার কমে আসবে বলে ধারণা করা যায়। এ জন্য সামাজিক জাগরণ জরুরি। কন্যাশিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে মানসিকতার পরিবর্তনের পাশাপাশি ইতিবাচক জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।