কবে আসবে সুদিন?

একজন অপরাধী যত তাড়াতাড়ি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে ততই তাকে দেখে অন্যরা অন্যায় করার আগে একবার হলেও ভাববে। আমরা কবে সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারব? কবে সেই দিন আসবে যখন নুসরাত বা নিতুর আত্মা বিচার পাওয়ার আশায় গুমরে কাঁদবে না। আর কতদিন অপেক্ষা করলে সেই সুদিন আসবে?

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

হালিমা রিমা
পত্রিকার পাতা উল্টালেই প্রথমে চোখে পড়ে অমুক স্থানে একজন শিশু ধর্ষিত, না হয় একজন শিশু মসজিদের ইমাম দ্বারা বলাৎকারের শিকার। দিন দিন যেন এসব খবরের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষের নির্মম আচরণ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিন বছরের শিশুও হয় লালসার শিকার। না ভুল বললাম। যে কোনো বয়সী সে শিশু বা বৃদ্ধা যে কেউ হতে পারে! পাশাপাশি রাস্তায় বের হলেই মেয়েরা হয় ইভ টিজিংয়ের শিকার। স্কুলের ছোট শিশুটিও বাদ পড়ে না। যেন এক পৈশাচিক আনন্দ দিয়ে যায় ওই সব মানুষ নামক পশুদের মনে। আমরা অনেকেই সন্তানকে একা চলাচল করতে দেই না। কিন্তু সবার পক্ষে এটা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলব, যখন স্কুলে যেতাম বড় সিনিয়র যারা ছিল রাস্তায় বিভিন্ন কটূক্তি করত। আমি ছিলাম খুব ভিতু স্বভাবের তাই মাথা নিচু করে চলে আসতাম। কখনো স্কুলের দেয়ালে দেখেছি নিজের নাম। কেউ একজন অন্য একটি নামের সঙ্গে+সাইন দিয়ে আমার নামটি লিখে দিয়েছে। এটা নিয়ে চলত হাসাহাসি। ক্লাশের বন্ধুরাই আড়ালে মুখ টিপে হাসত। আমি লজ্জায়, ঘৃণায় কষ্টে অনেক দিন কেঁদেছি। না এটা নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনার সুযোগ হয়নি। আর মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্বটা ছিল অনেক। কিছুদিন আগে আমার শাশুড়ি মায়ের ফোনে একটি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি রেগে আমাকে ফোনটি এগিয়ে দিয়ে বললেন দেখতো কে আমাকে আজেবাজে কথা বলছে। উনার বয়স ৮০+ কিন্তু মেয়ে কণ্ঠ তাই ইয়ার্কি না করলেই যে নয়! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের ত্যাক্ত করার ধরন পালটেছে এখন শুধু আজেবাজে কটূূক্তিই নয় সঙ্গে থাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি। কত মেয়ে মাঝপথে তার পড়ার পাট চুকিয়েছে এদের ভয়ে। না আছে কোনো শক্ত আইন না সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ করে! সবাই ভয় পায়। হয়তো তারা কোনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা নামধারী প্রভাবশালী। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি এর পেছনে কি কি কারণ নিহিত আছে। আমরা খুব ছোট শিশু কন্যাটিকে ছোটবেলা থেকেই পুতুল কিনে দেই, না হয় হাঁড়িপাতিল কিনে বসিয়ে দেই। সে ছোটবেলা থেকেই বড় হয় খুব নাজুক, কোমল হিসেবে। তার ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্ততি আমরা ছেলেবেলাতেই দিয়ে দিই। আমরা তাকে পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে জানতে দিই না। তার শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গটি চিনিয়ে দিই না। একটা নরম কাদামাটির মতো হয় তার বেড়ে ওঠা। অন্যদিকে ছেলেশিশুটি বেড়ে উঠে ঠিক তার উল্টোভাবে। ছোটবেলাতেই বাবা-মা হয়ে আমরা তার হাতে তুলে দিই খেলনা পিস্তল, ব্যাট বল। শিশুটি ছোটবেলা থেকেই তার ছোট বা বড় বোনের ওপর খবরদারি করা শুরু করে দেয়। বাবা-মা প্রশান্তি লাভ করেন এই ভেবে যে ব্যাটা মানুষ কত তার সাহস! আমরা এখনো এই সভ্য জগতে এসেও দেখি আমাদের দেশে রাস্তার আনাচে-কানাচে দাঁড়িয়ে ছেলেরা দিব্যি প্যান্টের চেন খুলে প্রস্রাব করে। এ যেন খুব স্বাভাবিক। লজ্জা আর সভ্য হয়ে চলার দায় যে শুধু মেয়ে শিশুটির বা মেয়েদের! আমরা একটা ছেলেকে দিই অবাধ স্বাধীনতা। স্কুল থেকে বা কলেজ থেকে ফেরার পথে সে আড্ডা দিবে এটা খুব সহজভাবে দেখি। বাবা-মা জানতেও চেষ্টা করেন না সে আসলে এই সময়টা কি করছে। বেশ কিছুদিন শুনেছিলাম ইভ টিজিং করলে মোবাইল কোর্ট সঙ্গে সঙ্গে সাজা প্রদান করবে। কিছুদিন পত্রিকায় দেখেছি মোবাইল কোর্ট ছয় মাসের সাজা প্রদান করেছে। ওই কিছুদিন........ তারপরই শেষ। এখন আর তেমনটা শোনা যায় না। আমার মনে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি প্রমাণিত হয় যে, সে কোন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র তবে তাকে উপযুক্ত কাউন্সেলিং এবং এরপর যদি শুধরে না যায় তাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রবেশনে রাখা যায়। অভিভাবককে ডেকে তার বিষয়ে সচেতন করা যায়। একটা শিশু যখন বড় হয় সে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা অবলোকন করে বেড়ে ওঠে। তাই মা-বাবাদের বলছি, ছেলে সন্তানকে ছেলে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন। ছোটবেলা থেকেই ছেলে সন্তানের জন্য এক নিয়ম মেয়ে সন্তানের জন্য অন্য নিয়ম। বেশিরভাগ বাবা-মা ছেলে সন্তান কার সঙ্গে মিশছে বা দেরি করে বাসায় ফিরছে এ নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই। অথচ সমস্যার শুরু সেখানেই। মনে পড়ে যখন কলেজে যেতাম বাসে করে, এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে সঙ্গে বেস্নড রাখতাম। একবার এক বয়স্ক লোকের হাতে আঘাতও করেছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখেছিলাম লোকটিকে বাস থেকে নেমে যেতে। সবসময় ভয় আর শঙ্কা কাজ করত। হঁ্যা এই প্রতিকূলতার মাঝে প্রতিটি মেয়েকে যেতে হয়। কিছু বিকৃত রুচির মানুষের জন্য এই সময়টা সব মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েকেই মোকাবেলা করতে হয়। দিন দিন যেন সমস্যা বেড়েই চলেছে। অথচ উন্নত দেশগুলোতে মেয়েদের এই সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয় না। আমি কিছুদিন লন্ডনে ছিলাম। সেখানে দেখেছি সকালবেলা আনডারগ্রাউন্ড (পাতাল রেল) রেলে অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করে। ভিড়টা অনেকটা আমাদের দেশের লোকাল বাসের মতোই। অথচ সেখানে যাতায়াতে কোনো মেয়ে জড়সড় হয়ে দুহাতে ব্যাগটি বুকে চেপে দাঁড়িয়ে থাকে না। কারণ তাদের কোনো ভয় নেই। রোববার রাতে পার্টি করে অনেকেই মদ পান করে রেলে উঠত। না তারা কেউই মেয়েদের দেখে লালায়িত হতো না। সেখানে মেয়েরা মধ্য রাতেও নিরাপদ। এখন পাবলিক বাসে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। বাসের হেল্পার আর ড্রাইভার দ্বারা মহিলা উত্যক্ত হওয়া বা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা এখন খুব সহজ বিষয়। তাই মনে ভয় জাগে মেয়েরা কিভাবে নিজেদের রক্ষা করবে? মনোবল সাহস আর বিচক্ষণতা দিয়ে হয়তো কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়। পৃথিবীর সব দেশেই ধর্ষণের শাস্তি খুব কঠিন এবং অপরাধটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। ইন্ডিয়াতে অপরাধীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃতু্যদন্ড দেয়া হয়ে থাকে। ফ্রান্সে ধর্ষণকারীর হিংস্রতা ও ভয়াবহতার ওপর নির্ভর করে ১৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেয়া হয়ে থাকে। চায়নাতে মৃতু্যদন্ডই একমাত্র শাস্তি। একজন অপরাধী যত তাড়াতাড়ি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে ততই তাকে দেখে অন্যরা অন্যায় করার আগে একবার হলেও ভাববে। আমরা কবে সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারব? কবে সেই দিন আসবে যখন নুসরাত বা নিতুর আত্মা বিচার পাওয়ার আশায় গুমরে কাঁদবে না। আর কতদিন অপেক্ষা করলে সেই সুদিন আসবে?