নারী নির্বিঘ্নে পৌঁছাক তার গন্তব্যে

বাঁচার তাগিদ। জীবন ও জীবিকার তাগিদ। আত্মনির্ভরশীলতার তাগিদ। নারীকে তাই বের হতেই হচ্ছে ঘর থেকে। যেতে হচ্ছে কর্মস্থলে। কিন্তু এই তাগিদের পেছনকার বিপত্তিটুকু কী প্রশাসন সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে না? যদি তা না হয়, তবে এর দায়ভার কার?

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

নন্দিনী ডেস্ক
বাসে ওঠার জন্য টিকেট কাটা থেকেই শুরু হয় নারীর বিপত্তি। এরপর বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময়ও তিক্ত অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতে হচ্ছে নারীকে। এ সময় আশপাশের কিছুসংখ্যক নিচু মানসিকতাসম্পন্ন লোকের অশ্লীল বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে অপমানিত করে, সংকুচিত করে। আবার বাসে ওঠার সময় পুরুষ যাত্রীদের ভিড় এত বেশি থাকে যে নারীর পক্ষে বাসে ওঠা সম্ভব হয় না। পুরুষরা যত সহজে বাসে উঠতে পারে, সে তুলনায় নারীকে বাসে উঠতে হয় অনেক কষ্ট করে। আর বাসে ওঠার পর আরও বেশি বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় নারীকে। বাসে ওঠার সময় নারী যাত্রীদের কন্ডাক্টর বা হেল্পারদের আচরণেও বিব্রত হতে হয়। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে এবং নারী যাত্রীদের বলে, তাদের জন্য সিট নেই। এই অতিরিক্ত যাত্রীর মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ, যারা নারীদের সংরক্ষিত আসন দখল করে বসে। নারীদের জন্য সংরক্ষিত যে পাঁচ-সাতটি আসন রয়েছে, তা ড্রাইভারের হাতের বাম দিকে, দরজার পাশে। কখনো নারীকে বসতে হয় ইঞ্জিন কভারের ওপর, যেটা নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আবার চালকের পাশে বসার কারণে বাস চালানোর চেয়ে নারী যাত্রীর দিকে চালকের মনোযোগই যেন বেশি থাকে। যে পাঁচ-সাতটি আসন নারীর জন্য, সুযোগ পেলে পুরুষরা তাও দখল করতে চায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, লোকাল বাসগুলোয় মোট যাত্রীর এক-তৃতীয়াংশ নারী এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ যাত্রী। কিন্তু মহিলা আসনের তুলনায় পুরুষ আসন ৭ গুণ বেশি। তার পরও অনেক কষ্ট-সহ্য করে নারীরা চায় গন্তব্যে পৌঁছতে। কারণ সঠিক সময় কর্মক্ষেত্রে পৌঁছতে না পারলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তিরস্কার সহ্য করতে হয়। ঢাকা শহরে আনুমানিক প্রায় ৫০ ভাগ নারী বাসে চলাচল করে (যাদের বেশির ভাগ কর্মজীবী ও ছাত্রী)। প্রয়োজনের তাগিদে তারা চলাচল করছে কিন্তু তাদের এ চলাচল কতটুকু নিরাপদ ও সম্মানজনক তা প্রশ্নের দাবিদার। পাবলিক বাসে চলাচল করছে এমন নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন সিএনজি বা ট্যাক্সিক্যাবে চলাচল তাদের জন্য খুবই ব্যয়বহুল। আবার সব রুটে সিটিং সার্ভিস নেই। যার ফলে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও লোকাল বাসে তাদের চলাচল করতে হচ্ছে। একজন নারী এ ধারণাকে বদ্ধমূল করে ঘর থেকে বের হচ্ছেন যে, প্রতিদিনের মতো আজও তার প্রতি যে কোনো ধরনের হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটবে এবং তিনি তা মুখ বুজে সহ্যও করে নেবেন। তার পুরুষ সহযাত্রী তার প্রতি হয়রানিমূলক আচরণ করা থেকে বিরত থাকা তো দূরে থাক, নূ্যনতম সম্মান দেখাতেই যেন কুণ্ঠাবোধ করে। পুরুষরা তাদের নারী সহযাত্রীকে মানুষ হিসেবে না দেখে নারী হিসেবে দেখে। এমনকি নারী শব্দের পরিবর্তে মেয়েছেলে বা মেয়েলোক শব্দগুলো বলতেই যেন পুরুষ সহযাত্রী বা বাসের হেল্পার, ড্রাইভাররা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাসের টিকেট কাটা থেকে আরম্ভ করে বাসে ওঠা এবং বাস থেকে নামা পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে নারী হচ্ছে হয়রানির শিকার। একশ্রেণির বিকৃত রুচির পুরুষ আছে, যারা নারীর কানের কাছে মুখ এনে এমন কিছু অশ্লীল শব্দ ছুড়ে দিয়ে বিকৃত সুখ উপভোগ করে যা ওই পুরুষের জন্য নয়, যেন নারীর জন্যই এটি লজ্জাজনক। অশ্লীল কথা, ধাক্কাধাক্কি ছাড়াও নারীর প্রতি যৌন হয়রানি এই শ্রেণির পুরুষের যেন দৈনন্দিন কর্মের অন্তর্ভুক্ত। নারীর প্রতি হয়রানি সম্পর্কে কিছু পুরুষ যাত্রী জানান, তারা নাকি নারীর প্রতি এমন হয়রানি দেখেননি। তাই নারীর প্রতি হয়রানির প্রতিবাদ একজন পুরুষ যাত্রীর কাছ থেকে আশা করাটাও বৃথা; কিন্তু একজন নারী যাত্রীও আরেকজন নারীর প্রতি অসম্মানজনক আচরণের প্রতিবাদ করছে না। নারীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা লজ্জায়, ভয়ে, অপমানে কোনো প্রতিবাদ না করে চুপচাপ বাস থেকে নেমে চলে আসছে। একজন নারী শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও অশিক্ষিত, মূর্খ তৃতীয় শ্রেণির মতো লোকের কাছ থেকে সম্মানটুকুও পাচ্ছে না। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও নারী পুরুষের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছে; কিন্তু উন্নত বিশ্বে এমনকি পাশের দেশ ভারতেও যেখানে নারী নিশ্চিন্তে, নিরাপদে চলাচল করছে সেখানে আমাদের দেশের নারী ঘর থেকে বের হতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। নারীর নিশ্চিন্তে চলাচলের ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। আর এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাসের ভেতর সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জন্য উদ্যোগী হতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সব যাত্রীর সচেতন হওয়ার দরকার আছে। কোনোরকম হয়রানি ছাড়া জীবন ও জীবিকার তাগিদে পৌঁছতে পারে সেদিকে নজর দেয়া দরকার সবারই।