উত্তরাধিকারীর যোগ্য অধিকার

প্রকাশ | ২৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
শ্রেণি সমতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর উত্তরাধিকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় ছবি: আসমা শোভা
'বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি? কোথায় তবে নারীর বাড়ি?' কথাগুলো অর্থহীন-অবান্তর মোটেও বলার উপায় নেই। আমাদের সমাজজীবনের বাস্তবতায় প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রেই কথাগুলো অতীব সত্য এবং দৃশ্যমানও বটে। হরহামেশা কথাগুলোর বাস্তব প্রয়োগ নারীর ক্ষেত্রে আমরা শুনে শুনে অভ্যস্ত। নারীর সামাজিক অমর্যাদাপূর্ণ বাস্তব অবস্থান এরূপই বটে। নারীমাত্রই বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি ভিন্ন নিজের বাড়িরূপে নির্দিষ্ট করে বলতে সম্পূর্ণ অপারগ। সে প্রচলনও সমাজে নেই। আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে কন্যাসন্তানের পিতা-মাতার সম্পত্তির অংশীদারিত্বের বিধান রয়েছে। তবে তা পুত্রসন্তানের প্রাপ্ত অংশের অর্ধেক। স্বামী এবং মৃত পুত্রের সম্পত্তির ষোল আনার মাত্র দুই আনা অংশের আইনিক দাবিদার। তবে পিতা বা স্বামী যদি জীবদ্দশায় নিজেদের সম্পত্তি পুত্রদের অনুকূলে দিয়ে যায়; সে ক্ষেত্রে কন্যা এবং স্ত্রী কানাকড়িও পায় না। নারীর উত্তরাধিকারী সম্পত্তি পাওয়া-না পাওয়া সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে পিতা বা স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা সব ক্ষেত্রেই ভূসম্পত্তি অধিকার বঞ্চিত। তারা পিতা, স্বামী বা সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয়। হিন্দু আইনে নারীকে সম্পূর্ণরূপে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণাপত্রে উলেস্নখ করা হয়েছে, দেশের মোট নারীর ৭০ শতাংশের কোনো সম্পত্তি নেই। অর্থাৎ সহায়-সম্বলহীন সিংহভাগ নারী। যারা অন্যের দয়া-অনুগ্রহে সমাজে পরগাছার মতো টিকে রয়েছে। ২৯ শতাংশ নারী উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভ করেছে। এবং অবশিষ্ট ১ শতাংশের সম্পত্তি থাকলেও নানা কারণে তাদের সম্পত্তি এখন তাদের অধিকারে নেই। পিতার সম্পত্তি থেকে নারীদের বঞ্চিত করার অজস্র ঘটনা-দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে রয়েছে। আইনিক দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনের আশ্রয় মামলা-মোকদ্দমায় অধিক অর্থ বিনিয়োগের কারণে বঞ্চিতরা আইনের আশ্রয়ের ওপর নির্ভর-আস্থাশীল হতে পারে না। আমাদের আইন-আদালতগুলোয় সুবিচার পাওয়া নির্ভর করে অর্থ জোগানের ওপর। অর্থের জোরেই সুবিচারনির্ভর। আইন ব্যবসায়ীদের আশ্বাসে যারা মামলা-মোকদ্দমা করেছে তারা প্রায় প্রত্যেকে অর্থনাশে ফতুর হয়েছে। উকিলদের কথায়-আশ্বাসে মনে হবে দ্রম্নত সম্পত্তির অধিকার ফিরে পাওয়া যাবে। সহজেই পুনরুদ্ধার হবে বেদখলকৃত সম্পত্তি। বাস্তবে যুগের পরিসমাপ্তিতেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। আমাদের সমাজে পুত্রদেরই বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারীরূপে গণ্য করা হয়। বিয়ের পর কন্যাসন্তানরা পিতার সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভাইদের কর্তৃত্বে থাকা সেই সংসারে কন্যারা অতিথিরূপেই আসা-যাওয়া করে। বৃদ্ধ পিতা-পুত্রদের আশ্রয়ে থাকার কারণে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে নিজের সম্পত্তি পুত্রদের লিখে দেয়। কন্যাদের বঞ্চিত করে পুত্রদের সম্পত্তি দেয়ার ঘটনা দেশে সর্বাধিক। পিতার সম্পত্তি এজমালি থাকলেও সেই সম্পত্তির অধিকার কন্যাসন্তানদের পাওয়া দুরূহ। ভাইয়েরা দয়া পরবশে দিলে পাবে। না দিলে মামলা করে সম্পত্তি আদায় বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় সুদূর পরাহত। যেসব নারীদের স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাইদের তুলনায় অধিক সমৃদ্ধশালী-একমাত্র তারাই সহজে পৈতৃক সম্পত্তির অংশ অনায়াসে পেয়ে থাকে। নারীর অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতেই পিতৃ সম্পত্তি পাওয়া না পাওয়া অনেকটা নির্ভর করে। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। সেটা খুবই নগণ্য। নারীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তির মূলে অর্থনৈতিক বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। শ্রেণি সমতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর উত্তরাধিকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সংস্কারের মাধ্যমে তো নয়-ই। বিদ্যমান ব্যবস্থাটি অপরিবর্তিত রেখে যে সংস্কারই করা হোক না কেন-তা টিকবে না। সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন। পুঁজিবাদ মুনাফানির্ভর কোনো কিছুকে ছাড় দেয় না। পণ্যে পরিণত করে। সংস্কৃতিসহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব-বিনোদনে অনুদান-পৃষ্ঠপোষকতার বাতাবরণে পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হয়। সংস্কৃতিকে পর্যন্ত পুঁজিবাদ করতলগত করেছে পণ্য প্রচারের হাতিয়াররূপে। দাস বা সামন্তযুগ নারীকে বন্দি করেছিল। পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষে বন্দি করেনি। কিন্তু পণ্যের দাসীতে পরিণত করেছে। পুঁজিবাদ নারীকে পণ্যেরও পণ্যে পরিণত করে থাকে। পণ্যের প্রচার-প্রসারেও নারীকে অপরিহার্য পণ্যরূপে গণ্য করে। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিতেই পুঁজিবাদের সামগ্রিক অপতৎপরতা স্পষ্ট। নারী-পুরুষের বৈষম্য সৃষ্টিতে পুঁজিবাদ সর্বাধিক ভূমিকায় অবতীর্ণ। দাস-সামন্তযুগের মতো পুঁজিবাদের ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা নেই। অতীত যুগের মতো পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ও নারীর জন্ম অপরাধতুল্য। নারী বৈষম্য, নারী নির্যাতন, নারীর সম্পত্তির অধিকার হরণ সব অনাচারের নেপথ্যে পুঁজিবাদের ভূমিকা খুবই স্পষ্ট। পুঁজিবাদ উচ্ছেদ-আক্রমণ তাই অতি জরুরি। সাম্রাজ্যবাদের শোষণ যন্ত্র পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শিকার দেশ এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। আমাদের শাসকগোষ্ঠীগুলো পর্যন্ত পুঁজিবাদে আস্থাশীল। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই সব বৈষম্য-নিপীড়ন শিকলের বেষ্টনীতে আটকে রয়েছে। নারীর সম্পত্তির সমান অধিকার; নারী অধিকারের অন্তর্গত। অসমতা কখনো ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারে না। আইন-ধর্মীয় বিধান পরিবর্তনে নারী অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। প্রচলিত আইনে বহু ইতিবাচক বিধান রয়েছে। আইনের সব বিধান কি সমাজে পরিপূর্ণরূপে পালিত হয়? হয় না এবং হওয়ার উপায়ও নেই। আইন করে নারীর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত হবে না। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। জনগণ কি মালিকানার জোরে রাষ্ট্রের ওপর নূ্যনতম কর্তৃত্বের অধিকার রাখে? রাখে না। বরং প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের অনাচারে অতিষ্ঠ-বিপন্ন। এই রাষ্ট্র নিপীড়ক এবং গণবিরোধী। অথচ এ রাষ্ট্রের মালিকানা আইনিভাবে জনগণের। বিষয়টি নিশ্চয়ই হাস্যকর, কৌতুকপূর্ণ এবং উপহাসতুল্য। সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। যা সংস্কারে মোটেও সম্ভব নয়। একমাত্র সমাজ পরিবর্তনেই সম্ভবপর। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার মূলে সমাজ বিপস্নব। একমাত্র সমাজ বিপস্নবেই সব শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়নের অবসান হবে। মুক্তি নিশ্চিত করবে সব মানুষের। য় নন্দিনী ডেস্ক