শ্রদ্ধাঞ্জলী

বাংলাসাহিত্যে রিজিয়া রহমান

জোনাকী থেকে নক্ষত্র

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
শেলী সেনগুপ্তা কবিতা দিয়ে যার জীবন শুরু হয়েছিল অথচ তার কোনো কবিতার বই-ই প্রকাশিত হয়নি, এমনি এক ভিন্ন পথে হাঁটা একজন লেখক রিজিয়া রহমান। যার কাছে জীবন খুব বৈচিত্র্যময়, দুঃখ-কষ্ট ও সুখের, এক এক সময় এক এক রকম। জীবনকে যিনি বহুমাত্রিক দৃষ্টিতে দেখেছেন, উপভোগ করেছেন নিজের মতো করে, অনুরাগে ও ভালোবেসে, তিনি বাংলাসাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। তিনি বাংলা সাহিত্যকে নিজের ঘরানায় এনে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। তার রচনা হয়তো অনেকের মতো বহুল পঠিত হয়নি, তবে তার ক্ষুরধার লেখনি একটি আলাদা ধারা তৈরি করেছে। ভিন্নধারায় হেঁটে তিনি পঞ্চাশেরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রতিটি গ্রন্থের ভাষাই বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রাসাদগুণসম্পন্ন। রিজিয়া রহমান ইতিহাসের বন্ধুর পথে চলতে চলতে আঁচল ভরে তুলে এনেছেন সাহিত্যের সুমিষ্ট ফল, তারপর তা রসাকারে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাসাহিত্যামোদীদের মাঝে। সৌভাগ্যবানরা সে রস আস্বাদন করতে পেরেছেন। যারা পারেননি তারা এখনও তা গ্রহণ করতে পারেন। তার রচিত নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস 'বং থেকে বাংলা'। এটি রচনা করার সময় তিনি নিজেকে শিক্ষার্থীর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সঠিক তথ্যের জন্য ড. নিহাররঞ্জন রায়ের গ্রন্থ থেকে শুরু করে নানা ধরনের পুঁথিও দ্বারস্থ হয়েছে। বাহাত্তর থেকে শুরু করে পঁচাত্তর পর্যন্ত দীর্ঘসময় নিয়ে গ্রন্থটি লিখেছেন। শুধু এটি বলে নয়, তার রচিত সব গ্রন্থের জন্য কখনো সাগর সেচে কখনো মরুময় পথে হেঁটে কখনো ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে চলে ফিরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। যিনি বাংলার আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস গেঁটে গ্রন্থ রচনা করেছেন সেই তিনিই আবার শিশুসাহিত্যের মাঙ্গলিক পথে সফল পদচারণা করেছেন। তার রচিত 'আজব ঘড়ির দেশে' শিশুদের জন্য একটি সায়েন্স ফিকশন, এতে পৃথিবীর শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত পেরিয়ে আসা স্তর ও জীবজন্তুর কথা লিখেছেন। তাতে শিশুমন অনেক সমৃদ্ধ হতে পারে। তিনি শিশুদের জন্য ছড়ার বই প্রকাশ করেছেন, 'মতি শীলের মা ও অন্যান্য' নামে একটি শিশু-কিশোর গল্প বইও লিখেছেন। রিজিয়া রহমান এমন একজন লেখক যার মধ্যে একজন শিশু থেকে পরিণত মনের মানুষের নিত্য আসা-যাওয়া। তাই বুঝি তিনি সাহিত্যকে আপন খেয়ালে মন্থন করেছেন, তুলে এনেছেন সুবাসিত, সুললিত, সুন্দর উপভোগ্য গদ্যগাথা। যে মানুষটি বাংলাসাহিত্যের আনাচেকানাচে ইতিহাস থেকে সংগৃহীত রস সুন্দর ভাষায় ছড়িয়ে দেয়ার মহান কাজটি করেছেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিভৃতচারী। এমন একটা ভাব ছিল তার মধ্যে, 'আমি তো আমার কাজ করেছি, পারো তো তোমরা খুঁজে নাও'। বড় বেশি আপন ভুবনে বসবাসকারী মানুষটি জীবনের একটা দীর্ঘসময় নিজেকে কলমের কাছে সমর্পণ করেছেন। তাই তো তার পরিশ্রম ও প্রতিভার সমন্বয়ের ফলে প্রতিটি লেখা মূল্যবান হয়ে উঠেছে, বিষয়টি নির্বাচনেও তিনি অসম্ভব সাহসী ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। অনেকেই যা ভাবতে পারে না, তিনি সেসব বিষয় নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তার দেখার দৃষ্টি ছিল সুদূর পরাহত- যা একজন লেখককে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে সহায়তা করে। স্বল্পভাষী, শান্ত ও নির্লিপ্ত মানুষটির লেখায় তার স্বভাব ফুটে উঠেছে। তাইতো তিনি অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে অংকন করেছেন ইতিহাসের চরিত্র, বারবনিতা, চা শ্রমিক, আদিবাসী, খনি শ্রমিক, হাঙ্গরশিকারীকেও। তার নির্লিপ্ত জীবনের ছোঁয়া তার লেখাতেই পাওয়া যায়। সবকিছুকে ছাড়িয়ে তার মধ্যে একটা চমৎকার পরিমিতিবোধও পরিলক্ষিত হয়। তার লেখার মধ্যে আছে একটা দৃঢ়ভাব- যা তাকে অনেকের কাছ থেকে আলাদা করেছে। লেখার সমৃদ্ধি ও উষ্ণতা আনয়ন করার জন্য তিনি মানুষের জীবন পাঠ করেছেন নিবিড়ভাবে। রিজিয়া রহমানের লেখার বিষয়বস্তু কখনোই ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, সবসময় সামষ্টিক চেতনা নিয়েই তিনি লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেছেন। ষাটের দশক থেকে যিনি সাহিত্যের অঙ্গনে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন সত্তর ও আশির দশকে এসে তা ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। সে উজ্জ্বলতা এতটাই প্রখর যে, তা কখনো কোনো সময়ই ম্স্নান হওয়ার নয়। ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর কলকাতার ভবানীপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই নক্ষত্র পারিবারিকভাবে জোনাকি নামেই পরিচিত ছিলেন। চিকিৎসক পিতা ও গৃহিণী মায়ের এই সন্তান জন্ম থেকে একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছেন। শিশুকালের সাংকৃতিক পরিবেশের প্রভাব পরিবর্তী সময়ে তার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে একটা চমৎকার ছন্দ এনে দিয়েছে এবং জোনাকি নামের মেয়েটি ক্রমে ক্রমে বাংলাসাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছে। যতদিন বাংলাসাহিত্য ও বাংলাসাহিত্যামোদীরা থাকবে ততদিন পর্যন্ত তিনি ও তার রচনা সাহিত্যের ভুবন আলোকিত করে থাকবে। এই মহান ও ব্যতিক্রম ধারার লেখককে শোক ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করছি।