বাংলার প্রথম নারী রচয়িতা

মধ্যযুগের প্রখ্যাত ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতী। এক ত্রিভুজ প্রেমের রাজসাক্ষী চন্দ্রাবতী, শুধু কি তাই? এক হৃদয়বিদারক কাহিনী ঘটেছে চন্দ্রাবতীর জীবনে। এখন আর ফুলেশ্বরী নদীর কোনো চিহ্ন নেই। তবে পাথুয়াইর গ্রামেই মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির ও তার পূর্ব পুরুষের বাড়ির স্মৃতি বয়ে চলছে আজো। কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির আর ভগ্নপ্রায় কয়েকশ' বছরের পুরনো বাড়ি। যার প্রতিটি ইটের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। আজ চন্দ্রাবতী নেই। কিন্তু কিশোরগঞ্জে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর প্রেমের কাহিনী এবং তাদের ট্র্যাজিক পরিণতি এখনো গানে গানে ও লোকজ নাটকে অভিনীত হয়।

প্রকাশ | ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
রহিমা আক্তার মৌ আজ থেকে বহু বছর আগে বাংলাসাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির জীবনে ঘটেছিল করুণ পরিণতি। এক ত্রিভুজ প্রেমের রাজসাক্ষী চন্দ্রাবতী, শুধু কি তাই? এক হৃদয়বিদারক কাহিনী ঘটেছে চন্দ্রাবতীর জীবনে। মধ্যযুগের প্রখ্যাত ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতী। পিতা মনসা মঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত রচয়িতা কবি দ্বিজ বংশী দাস (বংশীবদন ভট্টাচার্য), এবং মাতার নাম সুলোচনা। বাংলাসাহিত্যে চন্দ্রাবতী একটি নতুন দিগন্তের নাম। সপ্তম-অষ্টম শতকে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও ষোড়শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের পরের দিকে আবির্ভাব হয় প্রথম বাঙালি মহিলা কবির। বাবার মতো তিনি ছিলেন ভাসান কবি, গীতিকার আর রামায়ণের রচয়িতা। এই বিদুষী নারী পিতার আদেশে বাংলাভাষায় কাব্যাকারে রামায়ণ রচনা করেছিলেন। ষাট ও সত্তর দশকে স্থানীয়ভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার হাত ধরেই চন্দ্রাবতীর পালার প্রচলন শুরু হয়। চন্দ্রাবতী বাল্যকালে পড়ালেখার সময় একই গ্রামের সহপাঠী জয়ানন্দ চক্রবর্তী নামের এক অনাথ বালকের প্রেমে পড়েন। জয়চন্দ্র তার মাতুলগৃহে পালিত বাবা বংশী দাস কন্যার মনোভাব জেনে জয়ানন্দের কাছেই তাকে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন। দুই পরিবারের সম্মতিতে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু এরই মাঝে ঘটে যায় এক নাটকীয় ঘটনা। বাল্যপ্রেমকে পদদলিত করে চঞ্চলমতি জয়ানন্দ ত্রিভুজ প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় মুসলমান শাসনকর্তা বা কাজীর মেয়ে আসমানির অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ জয়চন্দ্র আসমানিকে একাধিক প্রেমপত্র লেখে জানায় যে, সন্ধ্যায় চন্দ্রাবতী বিবাহবেশে অপেক্ষমাণ জয়ানন্দের জন্য, ঠিক সে সন্ধ্যায় খবর আসে, কাজী জয়চন্দ্রকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে এবং মেয়ে আসমানিকে বিয়ে দেন। এ নিদারুণ সংবাদে লগ্নভ্রষ্টা-চন্দ্রাবতীর হৃদয় ভেঙে যায়, স্তম্ভিত চন্দ্রাবতী নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেন। প্রচন্ড আঘাতে মুষড়ে পড়া কন্যাকে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য আপত্য স্নেহে এগিয়ে আসেন পিতা দ্বিজ বংশী দাস। বংশী দাস বিষাদগ্রস্ত কন্যার মনে শান্তি ফেরাতে তাকে অন্যত্র পাত্রস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় চন্দ্রাবতী পিতার কাছে দুটি বর প্রার্থনা করেন। একটি চিরকুমারিত্ব বরণ ও নিজ গৃহে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে অবশিষ্ট জীবন শিবের পূজায় অতিবাহিত করা। নিরুপায় হয়ে পন্ডিত পিতা কন্যার দুটি প্রার্থনাই মঞ্জুর করেন। আনুমানিক ১৬০০ সালের কথা। প্রতিদিনের মতো চন্দ্রাবতী মন্দিরে বসে রামায়ণ লিখছিলেন। এ সময় অনুশোচনায় অনুতপ্ত জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে আসে। মন্দিরের রুদ্ধদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে জয়ানন্দ বারবার চন্দ্রাবতীকে নাম ধরে ডেকেও কোনো সাড়া পায় না। এই নীরবতাকে চন্দ্রাবতীর প্রত্যাখ্যানের ভাষা মনে করেন তিনি। শত অনুনয়েও তার মন জয় করতে না পেরে জয়ানন্দ মনের দুঃখে শিবমন্দির গাত্রে শেষ বিদায়সূচক কয়েকটি কবিতার চরণ লিখে পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আবার কারও কারও মতে তখন চরাচরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করে চন্দ্রাবতী সন্ধ্যারতি এবং শিবের পূজায় মগ্ন। ধ্যানে মগ্ন ছিলেন বলেই জয়ানন্দের ডাক শুনতে পারেননি তিনি। বুঝতেও পারেননি জয়ানন্দ এসেছিল। ব্যর্থ-মনোরথ জয়ানন্দ, লাল রঙের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দরোজায় ৪ ছত্রের একটি পদ্য লিখে সে স্থান ত্যাগ করেন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর চন্দ্রাবতী মন্দির থেকে বের হয়ে জয়ানন্দের লেখা- 'শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী/ অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী/পাপিষ্ঠ জানিয়ে মোরে না হইল সম্মত। / বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো'। কবিতার চরণ দেখে পবিত্র মন্দিরগাত্র থেকে এর চিহ্ন মুছে ফেলতে পানি আনতে নদীর ঘাটে যান। কিন্তু সেখানে টোলের সহপাঠী, বাল্য বয়সের খেলার সঙ্গী জয়ানন্দের মৃতদেহ নদীতে ভাসতে দেখে তার মনে ভাবান্তর ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তীব্র অনুশোচনায় একপর্যায়ে চন্দ্রাবতী ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়। যার ফলে অসমাপ্ত রয়ে যায় চন্দ্রাবতীর 'রামায়ণ' রচনা। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ মূলত একটি পালাবদ্ধ গীত। এ রামায়ণ ৩ খন্ডে মোট ১৯টি অধ্যায়ে রচিত হয়েছে- প্রথম খন্ড, জন্মলীলা। এ খন্ডে রয়েছে ০৮টি অধ্যায়। দ্বিতীয় খন্ডের কোনো নামকরণ করেননি চন্দ্রাবতী। এই খন্ডের ০২টি অধ্যায়ে যথাক্রমে সীতার বনবাস-পূর্ব জীবনের কাহিনী এবং বনবাসকালীন সময়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয় খন্ডেরও কোনো নামকরণ করেননি চন্দ্রাবতী। এই খন্ডের ৯টি অধ্যায় যথাক্রমে- সীতার বনবাসের সূচনা, সীতার বিরুদ্ধে কুকুয়ার চক্রান্ত, রামের কাছে সীতার বিরুদ্ধে কুকুয়ার মিথ্যা অভিযোগ, রাম কর্তৃক সীতাকে বনবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত, সীতার বনবাস, মুনি বাল্মীকির আশ্রয়ে সীতা কর্তৃক লব ও কুশের জন্মদান, সীতা-হনুমানের সাক্ষাৎ, রাম-হনুমানের সাক্ষাৎ এবং সীতার অগ্নি পরীক্ষা ও পাতাল প্রবেশের বর্ণনা। আশ্চর্য রকমের বৈপস্নবিক চিন্তাচেতনার অধিকারী ছিলেন চন্দ্রাবতী। তার বিস্ময়কর কাব্য-প্রতিভার পরিচয় মেলে তার রচিত 'দসু্য কেনারাম', 'মলুয়া পালা' এবং 'রামায়ণ'সহ অজস্র কবিতা ও লোক-সঙ্গীতের ছত্রে ছত্রে। তার কবিতা সুরভিত বনফুলের মতো। চন্দ্রাবতী রচিত গ্রন্থাবলি তাকে বাংলাসাহিত্যের একটি উত্তুঙ্গ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে; যে স্থানটি কেড়ে নেয়া অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বেদনাবিধুর জীবন কাহিনীর জন্যও চন্দ্রাবতী কিংবদন্তি হয়ে রয়েছেন। চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলো হলো- মলুয়া, দসু্য কেনারামের পালা, (মনসার ভাসান, রচনাকাল : ১৫৭৫ শতাব্দ) রামায়ণ। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। দীনেশচন্দ্রের মতে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মেঘনাদবধ কাব্যের সীতা-সরমার কথোপকথনের অংশটি 'চন্দ্রাবতীর রামায়ণ' থেকে গ্রহণ করেছিলেন। চন্দ্রাবতীর সাহিত্য-কর্ম বাঙালির হৃদয়-মনে যতখানি তোলপাড় সৃষ্টি করেছে, সে তুলনায় ব্যক্তি-চন্দ্রাবতীর ব্যাপারে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস ততখানিই উদাসিনতা প্রদর্শন করেছে। অপার-রহস্যের উৎস চন্দ্রাবতীকে আমাদের সাহিত্যে ঠিক যেভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন ছিল বা তিনি যেভাবে গবেষণার উপাত্ত হয়ে উঠতে পারতেন তেমনটি কিন্তু ঘটেনি। কবি চন্দ্রাবতী বাংলাসাহিত্যের এক ট্র্যাজিক নায়িকা। রোমান্টিক মনের অধিকারী চন্দ্রাবতীর বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের বিয়োগান্তক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় 'চন্দ্রাবতী পালা'য়। ১২টি অধ্যায়ে ৩৫৪টি ছত্রের এ লোকগাথা চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক একমাত্র লিখিত দলিল। এখন আর ফুলেশ্বরী নদীর কোনো চিহ্ন নেই। তবে পাথুয়াইর গ্রামেই মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির ও তার পূর্ব পুরুষের বাড়ির স্মৃতি বয়ে চলছে আজো। কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির আর ভগ্নপ্রায় কয়েকশ বছরের পুরনো বাড়ি। যার প্রতিটি ইটের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। আজ চন্দ্রাবতী নেই। কিন্তু কিশোরগঞ্জে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর প্রেমের কাহিনী এবং তাদের ট্র্যাজিক পরিণতি এখনো গানে গানে ও লোকজ নাটকে অভিনীত হয়।