রমা চৌধুরী

স্বাধিকারের ইতিহাস যার পদকমলে

১৯৭১ সাল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রমা চৌধুরী তখন পোপাদিয়ায়। পৈতিৃক ভিটায়। সঙ্গে তিন পুত্র সন্তান ও বৃদ্ধা মা। স্বামী তখন ভারতে। ১৯৭১ এর ১৩ মে। এই দিনটা রমা চৌধুরীর জীবনে কালো এক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। এই দিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হামলা করে উনার বাড়িতে। অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় রমা চৌধুরীর ওপর। নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি জীবন বাঁচাতে ঝাঁপ দেন পুকুরের জলে। প্রাণে বেঁচে যান। তারপর থেকে শুরু হয় দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন। রমা চৌধুরীর লেখা 'একাত্তরের জননী' গ্রন্থে সেইসব দুঃসহ দিনের কথা এভাবেই ফুটে উঠেছে

প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

রুম্পা রুমানা
বেঞ্জামিন পার্কারের বিখ্যাত একটা উক্তি মনে পড়ছে- 'ডরঃয মৎবধঃ ঢ়ড়বিৎ পড়সবং মৎবধঃ ৎবংঢ়ড়হংরনরষরঃু.' স্বাধীন দেশে আমাদের একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী সেই মহৎ দায়িত্বের ভার একাই বহন করেছিলেন! রমা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে। শিক্ষা জীবন শুরু করেন নিজ বিভাগেই। তারপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন ১৯৬১ সালে। সম্ভবত, তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর। কর্ম জীবন শুরু করেন কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে। ১৯৭১ সাল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রমা চৌধুরী তখন পোপাদিয়ায়। পৈত্রিক ভিটায়। সঙ্গে তিন পুত্র সন্তান ও বৃদ্ধা মা। স্বামী তখন ভারতে। ১৯৭১ এর ১৩ মে। এই দিনটা রমা চৌধুরীর জীবনে কালো এক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। এই দিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হামলা করে উনার বাড়িতে। অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় রমা চৌধুরীর ওপর। তিন শিশুপুত্র তখন ঘরে। নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি জীবন বাঁচাতে ঝাঁপ দেন পুকুরের জলে। প্রাণে বেঁচে যান। সেদিনই গানপাউডার ছিটিয়ে রমা চৌধুরীর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয় রাজাকার ও পাকিস্তানিরা। তারপর থেকে শুরু হয় দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন। রমা চৌধুরীর লেখা 'একাত্তরের জননী' গ্রন্থে সেইসব দুঃসহ দিনের কথা এভাবেই ফুটে উঠেছে। \হ'আমাদের দেখতে বা সহানুভূতি জানাতে যারাই আসছেন তাদের কাছে আমার নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাটা ফলাও করে প্রচার করছে অশ্রাব্য ভাষায়। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে খোন্দকার বাড়ির লোকরা। সে বাড়ির দু'তিনজন শিক্ষিত ছেলে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে এলে আমার আপন মেজকাকা এমন সব বিশ্রী কথা বলেন যে, তারা কানে আঙ্গুল দিতে বাধ্য হয়। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেয়ার জন্য।' তারপরের আট মাস কাটে জঙ্গলে লুকিয়ে। রাতের বেলা পুড়া ভিটেতে খড়-পলিথিন বিছিয়ে ঘুমিয়ে। বর্ষা কিংবা শীত, কোনো ঋতুতেই নিজেদের রক্ষা করার সম্বলটুকুও তখন অবশিষ্ট নেই। অনাহার-অর্ধাহারে সন্তানরা নানান অসুখে ভুগতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর রাত। বিজয়ের পূর্ব দিন। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ছেলে সাগরের। ডাক্তার-ওষুধ-পথ্য কিছুই নেই। চারদিন এভাবে থেকে ২০ ডিসেম্বর মারা যায় সাগর। শোকে তিনি তখন অর্ধ পাগলিনী। ১৯৭২-এর ১৫ ফেব্রম্নয়ারিতে আরেক ছেলে টগরও একই অসুখে ভোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তিনি তখন পাগলপ্রায় হয়ে উঠেন পুত্রদের শোকে। এই সন্তানদের জন্যই তিনি আত্মহনন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এই দুঃখিনী জননী সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী দুই পুত্রকে না পুড়িয়ে কবর দেন। পুত্রদের হারিয়ে তিনি একটানা চার বছর পায়ে জুতা পরেননি। যে পুত্রদের তিনি মাটিতে শুইয়েছেন সেই মাটির ওপর জুতা পায়ে হাঁটতে নারাজ ছিলেন তিনি। দীর্ঘ চার বছর এভাবে হাঁটার পর প্রতিবেশীদের অনুরোধে জুতা পায়ে তুলেন। তাও শারীরিক অসুস্থতায়। কিছুদিন জুতা পায়ে রাখলেও গত ষোলো বছর ধরে তিনি খালি পায়েই হেঁটে চলেন সবখানে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লাল-সবুজ পতাকা দিয়েছে, বিশ্বের মানচিত্রে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কেড়েও নিয়েছে অনেক। এমন দুঃখগাথা উপাখ্যানেরই এক নাম রমা চৌধুরী। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইবে আজীবন।