নির্যাতন রোধে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আইনের মতোই শক্তিশালী

বর্তমান সমাজের একটি বিশাল ব্যাধি 'নারী নির্যাতন'। সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন এ প্রবণতা বেড়ে চলেছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষাসহ নানা কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃতু্য হচ্ছে। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে। দেখা যায়, সমাজের সচেতন ও প্রভাবশালী মানুষের মাধ্যমেই নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটছে

প্রকাশ | ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুলস্নাহ
২৫ নভেম্বর পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয় 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'
বর্তমান সমাজের একটি বিশাল ব্যাধি 'নারী নির্যাতন'। সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন এ প্রবণতা বেড়ে চলেছে। মানুষ যতই সচেতন হচ্ছে, ততই নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞতা বৃদ্ধি পাচ্ছে; বৃদ্ধি পাচ্ছে উদাসীনতা। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষাসহ নানা কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃতু্য হচ্ছে। কারণ তারা মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে। দেখা যায়, সমাজের সচেতন ও প্রভাবশালী মানুষের মাধ্যমেই নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটছে। সহিংসতার রকমফের নারী নির্যাতন স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন ধরনের ও প্রকৃতির হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি হলো- আঘাত করা বা অপব্যবহার, যৌতুকের জন্য দৈহিক ও মানসিক চাপ, মানসিক নিপীড়ন, অপহরণ, বউ পেটানো, যৌন নিপীড়ন বা অপব্যবহার, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, বাল্যবিয়ে ও বহু বিয়ে, বিদেশে পাচার, অন্যায়ভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি এবং ধর্ষণ করতে গিয়ে জখম বা মৃতু্য ঘটানো ইত্যাদি অপরাধের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সহিংসতা প্রতিরোধে দিবস ও তার ফলাফল প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয় 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস'। এ দিবসটির ইতিহাসে মিশে আছে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্রপট; যা নারী সহিংসতারোধে চেতনা জাগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে তিনজন নারী নির্যাতিত হন। এ ঘটনার স্মরণে ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে প্রথম ল্যাটিন আমেরিকায় নারী অধিকার সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে নারী নির্যাতন বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পক্ষকালব্যাপী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৩ সালের ২৫ নভেম্বর জাতিসংঘ 'নারী নির্যাতন দূরীকরণ ঘোষণা' প্রকাশ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের খসড়া অনুমোদন করে ২৫ নভেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন দূরীকরণ দিবস' হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু বছরের পর বছর নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে আন্দোলন বা দিবস পালন করেও কি নির্যাতন কমেনি? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি চিত্র তুলে ধরলে অনেকখানি পরিষ্কার হওয়া যাবে। ইউনাইটেড নেশন পপুলেশন ফান্ডের জরিপে বলা হয়-'নারীর ওপর তার পুরুষসঙ্গীর শারীরিক নির্যাতনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে শতকরা ১৪ ভাগ মাতৃমৃতু্য ঘটছে গর্ভকালীন নির্যাতনের কারণে। শতকরা ৬১ জনের বেশি পুরুষ এখনও মনে করে স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করা বৈধ। এ ছাড়া নারীর প্রতি শতকরা ৮০ ভাগ সহিংসতা ঘটে পরিবারের ভেতরে। অন্যদিকে দেশে সংঘটিত মোট খুনের ঘটনার ৫০ ভাগই হচ্ছে স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার ঘটনা। নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে গ্রামাঞ্চলে। শহরাঞ্চলেও শতকরা ৬০ ভাগ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। মৌখিক নিপীড়নের শিকার হন ৬৭ শতাংশ নারী। তা ছাড়া যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বছরে গড়ে ৬০০টি।' সহিংসতা প্রতিরোধে করণীয় কি? আইনের যথাযথ প্রয়োগ : নারী নির্যাতন মামলায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহির বিধান রয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি সঠিকভাবে তদন্ত না করেন, তাহলে তাকে জবাবদিহি করতে হয়। তাকে চাকরিচু্যত করা কিংবা অব্যাহতি দেওয়ার বিধান রয়েছে। আবার পাবলিক প্রসিকিউটর মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে উদাসীনতা প্রদর্শন করলে তাকেও বাদ দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বিধিমালাগুলোর বাস্তবায়ন তেমন দেখা যায় না। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে শুধু আন্দোলন নয়, নারীর প্রতি এ সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বে নারীর অধিকার আদায় নিয়ে কাজ করছে, এমন অনেক সংগঠন রয়েছে। শুধু সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ করাই কাজ নয়, সহিংসতার শিকার প্রতিটি নারীকে যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করতে হবে। প্রতিটি মানুষকে নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় তথ্য জানাতে হবে। যারা মুখ খুলে কথা বলতে ভয় পায়, তাদের সাহস দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আইনি জটিলতা ও কালক্ষেপণ দূরীকরণ : নারী নির্যাতনের মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যেই শেষ করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করা হয় না। এর মূল কারণ জবাবদিহির অভাব। জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনা সম্ভব। কোনো একটি ঘটনার বিচারহীনতা নতুন আরেকটি ঘটনাকে জন্ম দেয়। নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা যায়, তাহলে আরও নির্যাতনের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কমে যাবে। দৃষ্টিভঙ্গির বদল : নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারবে। যার মাধ্যমে নারী পাবে সহিংসতার প্রতিকার। গড়ে উঠবে সহিংসতামুক্ত একটি সুন্দর সমাজ। তাই নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন- 'স্ত্রীকে মেরো না। তবে তুমিই কষ্ট পাবে।' আমরা হয়তো দেখি, একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে প্রহার করল। আর তা একপ্রকার নারী নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ল। অথচ এর কারণে যে ওই পুরুষটি কতটা কষ্ট পেল, তা আর দেখার সময় হয় না। কারণ নারী যে আমাদের মা, আমাদের বোন; পর কিংবা ভিন্ন কিছু নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গিটাই সবার আগে প্রয়োজন। এমন সব অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এই দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি আদর্শ ও নৈতিকতার দীক্ষা গ্রহণ করা জরুরি। নারী ও পুরুষ উভয়ে যেমন মানুষ, আর মানুষের সঙ্গে মানুষের মতোই আচরণ করতে হবে। মানুষ যখন অমানুষের মতো আচরণ করবে, তখনই সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য তাই আদর্শ ও নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ভূমিকা অনেকখানি। লেখক : সিনিয়র শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, আল জামিআতুল ইসলামিয়া ইসলামপুর (ভবানিপুর মাদরাসা), গোপালগঞ্জ