উচ্চশিক্ষায় নারীর অনগ্রসরতা ও আমাদের দায়

প্রকাশ | ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মোহাম্মদ অংকন
উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশী নারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রধান সমস্যা আবাসন সংকট
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শহরের পানে ছুটে আসছে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ। কেউ জীবিকার সন্ধান করছে, কেউ উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথ দেখছে। এসব মানুষের মধ্যে এক বিরাট অংশ রয়েছে নারী তথা ছাত্রী। উচ্চশিক্ষা অর্জনে প্রত্যাশী এই ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযাগ মিললেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ও নিরাপদ আবাসস্থল। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারাও অনেকাংশে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল পাচ্ছে না। প্রিয় ক্যাম্পাসের আঙিনা ছেড়ে থাকতে হচ্ছে বাইরে ভাড়া বাসায় কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছে। অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের জন্য। এগুলো প্রায় সময়ই উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোনো কোনো পরিবার উচ্চশিক্ষার অধিক ব্যয় বহন করতে না পেরে পড়ুয়া মেয়েদের জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে রয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রী মোটেও কম না। আধুনিক যুগে ছেলে ও মেয়ে সমান তালে উচ্চশিক্ষামুখী হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব আবাসিক ব্যবস্থা না থাকা ছাত্রদের যেমন থাকা-খাওয়া নিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে, তেমনি ছাত্রীরাও দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। ব্যাচেলর বলে ছাত্রদের বাসা ভাড়া না দেওয়া হলে তারা কয়েকজন মিলে বাসা ভাড়া নিয়ে মেস বানিয়ে থাকছে। (যদিও এ সুযোগ পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।) সেটা দেখাদেখি, ছাত্রীরাও আজকাল আবাসিক সমস্যার কারণে বাসা ভাড়া নিয়ে মেস বানিয়ে থাকছে। কিন্তু এটা কতটা অনিরাপদ? এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ভুক্তভোগীদের কথা শুনলে তা ভাবতেই অবাক লাগবে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে ঢাকায় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য নারী শিক্ষার্থীরা আসছে। এসেই তারা প্রথম যে ধাক্কাটি খাচ্ছে, সেটি হলো আবাসন সমস্যা। 'হায়, আমি কোথায় থাকব? আমার তো আত্মীয়-স্বজন নেই।' এটির কারণে অনেকের ঢাকায় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য আসা হয়ে ওঠে না শেষ পর্যন্ত। পরিবারের প্রধান চিন্তা হয়ে দাঁড়ায়, 'আমার মেয়ে থাকবে কোথায়?' এলাকার কেউ আছে, এমন কারও খোঁজ নিয়ে কিংবা কয়েকজন বান্ধবী মিলে অবশেষে শহরে পা রাখতে সক্ষম হয়। এখানেই শেষ নয়, যেসব মেয়েরা ঢাকায় মেস বানিয়ে থাকছে, তাদের নামে অঞ্চলভিত্তিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানো আছে, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। 'মেয়েটি ঢাকায় পরিবার ছাড়া থাকে, নিশ্চিত মেয়েটি খারাপ হয়ে গেছে।' আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিয়দংশ নারীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনে বাধা প্রদানে অভ্যস্ত। তাদের বিশ্বাস, 'ঘরের বাইরে নারীরা কেন যাবে? কেন তারা উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য শহরে পাড়ি জমাবে?' ধর্মীয় গোড়ামি, সামাজিক পারিপার্শ্বিক কিছু কারণে এমন নেতিবাচক চিন্তা ধারণার কারণে অনেক মেয়েই শহরে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাতে পারে না। যার কারণে উচ্চশিক্ষিতদের পরিসংখ্যানে নারীদের সংখ্যাটা কম। এমন বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল সাদিয়া রহমান নামের একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমার পরিবার কোনোমতেই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে ইচ্ছুক ছিল না। ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহরে গিয়ে থাকতে দেওয়া তো দূরের কথা।' কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, 'শহরের থাকার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই আমার জন্য, যেখানে থেকে পড়াশোনা করব। যেখানে ভর্তি হবো, সেখানেও নেই কোনো আবাসিক সুবিধা। সহপাঠীদের সঙ্গে মেস করে থাকব, সে সুযোগও নেই। কে কোন অপবাদের বোঝা চাপিয়ে দেবে, তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে। সবচেয়ে বড়, শহর আর নিরাপদ নয়।' সাদিয়ার কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, সত্যই কোনো শহরই আজকাল নিরাপদ নয় বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। প্রতিনিয়ত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। পথে-ঘাটে-বাসে নারীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। কখনো মেয়েরা গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদের সংখ্যা উলেস্নখযোগ্য। স্থানীয় বখাটেরা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছে যে মেয়েটি কোথায় থাকছে, কি করছে? যখন দেখছে কোনো এক বাসায় মেস করে থাকছে, তখন বখাটেরা ঠিকই ধরে নিচ্ছে, আপাতত এ মেয়ের অভিভাবক নেই। এর প্রতি চড়াও হওয়া যেতেই পারে। এমন আক্রোশের শিকার অনেকেই। নারীদের অসহায়ত্বের সুযোগে প্রতিনিয়ত কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এসবই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাচ্ছে। ভয়ে মুখ খুলছে না বেশির ভাগ মেয়েরা। এমনই এক ঘটনার শিকার হয়েছিল একটি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হানি জান্নাত। তার থেকে জানতে পারা যায়, 'আমি রাতের দিকে টিউশনি করে বাসায় ফিরি। স্থানীয় কিছু বখাটেরা আমার পদক্ষেপগুলো নোট করে। আমাকে ফলো করে। আমি কোথায় পড়ছি, কোথায় যাচ্ছি। এক সময়ে আমার কাছে তাদের পক্ষ থেকে বাজে প্রস্তাব আসে।' তিনি বলেন এর মূল কারণ, 'আমি পরিবার ছাড়া থাকছি। অভিভাবকহীনতার সুযোগ নিয়ে বখাটেরা আমাকে বাজে প্রস্তাব দিতে সক্ষম হয়েছে। আমি যে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছি, সেখানে যদি আবাসিক ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আমাকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না। এ বিষয়গুলোর উত্তরণ দরকার।' পরিশেষে বলা যেতে পারে, শুধু ঢাকা শহর নয়- প্রতিটি জেলা ও বিভাগী শহরের বুকে পড়তে আসা নারীদের আবাসিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের আবাসিক হলের সংখ্যা বাড়াতে হবে যাতে ভর্তি হওয়ার পরদিন থেকেই তারা একটি নির্দিষ্ট থাকা-খাওয়ার জায়গা পায়, যেটা হবে নিরাপদ এবং নারীবান্ধব। সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। কেননা, অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি নিয়ে একদমই ভাবে না। তারা যেমন নারীশিক্ষার পথকে সুগম করতে কাজ করে যাচ্ছেন, তেমনি ছাত্রীদের নিরাপদ আবাসনের লক্ষ্যে ক্যাম্পাসগুলোতে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের দেখভালে থাকা মানে অভিভাবকের কাছেই থাকা। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদগুলো আসবে না। নারীরা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে যাবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। লেখক: প্রাবন্ধিক, ঢাকা।