মাদকে জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা

প্রকাশ | ১৩ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

তুলি সোবহান
ভয়াল নেশায় জড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানসহ বাদ নেই কোনো শ্রেণিই। তবে নেশাসক্ত শিশু-কিশোরদের মধ্যে পথশিশুদের সংখ্যাই বেশি। যাদের অধিকাংশের বাস আবার বস্তিতে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫০ লাখ। তার মধ্যে শিশু ও কিশোর মাদকাসক্ত রয়েছে ৩ লাখ ২৪ হাজার। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাব মতে, এই সংখ্যা আরও বেশি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শিশু ও কিশোররা প্রথমে সিগারেট দিয়ে নেশার জগতে প্রবেশ করে। এরপর তারা আস্তে আস্তে ফেনসিডিল ও ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, গ্রামের চেয়ে শহরে বসবাসরত নারীরা আনুপাতিক হারে মাদকে বেশি আসক্ত হচ্ছে। তারা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারে সচ্ছলতা রয়েছে। তাদের মধ্যে আবার শিক্ষিত তরুণীরাও রয়েছে। এই সংখ্যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ পড়ুয়া তরুণীরাও। অনেকে হতাশাগ্রস্ত এবং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় অথবা বন্ধুদের কাছে বিভিন্ন রকম কুমন্ত্রণা পেয়ে ওই মাদকগুলো গ্রহণ করে থাকে। সিগারেট, গঁাজা, ইয়াবা, প্যাথিড্রিন, ফেনসিডিল ও হেরোইনে আসক্ত হচ্ছে। তবে শহরে নারীরা বেশি আসক্ত ইয়াবা আর এলকোহলে। বাংলাদেশে মাদক হিসেবে একসময়ে ফেনসিডিল শীষর্স্থান দখল করলেও, এখন ইয়াবা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে? এর প্রধান ব্যবহারকারী বতর্মান তরুণ প্রজন্ম? কারণ, মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ইয়াবার বাজারজাতকরণ অনেকটা সহজ হয়ে পড়েছে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, আশঙ্কাজনকভাবে এই পুরো প্রক্রিয়াটির সাথে প্রতিদিন জড়িয়ে পড়েছে হাজারো নারী ও শিশু। মাদকের চোরাচালান, বাজারজাত ও সামগ্রিক বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে নারীদের পাশাপাশি কোমলমতি শিশু-কিশোররাও। একশ্রেণির অসাধু চোরাকারবারি ও কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্যের কাছে বলি হচ্ছে, এসব নারী-শিশু। এদেরকে দিয়ে এসব অনৈতিক ও রাষ্ট্রবিরোধী কমর্কাÐে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়াগুলো খুললে চোখে পড়ছে এমন হাজারো সংবাদ। ক্ষেত্রবিশেষে নারী-শিশুদের জোরপূবর্কও কাজে লাগানো হচ্ছে। এসব মাদক চোরাকারবারের আড়ালে পাচার হচ্ছে, নারী-শিশুসহ হাজার হাজার কোটি টাকা। নেপথ্যে চলছে অবৈধ অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা। বলা হয়ে থাকে, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের কতর্ধার।’ অথচ আগামী দিনের কতর্ধারদের এভাবে সমূলে ধ্বংস করে দিচ্ছে ভয়াবহ মাদক। দেশের একটা বৃহৎ অংশ আজ ধ্বংসাত্মক ইয়াবার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত। বাংলাদেশের মাদকবিরোধী সংস্থা মানস বলছে দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্ত ব্যক্তির ১৬ শতাংশই নারী। মাদকবিরোধী সংস্থা মানস বলছে পঁাচ বছর আগে নারীদের মধ্যে মাদক নেয়ার প্রবণতা ছিল ৫ শতাংশ। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে পনের শতাংশ নারী নানা ধরনের মাদকে আসক্ত বলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। আর এদের ৪৩ শতাংশ নারী সেবন করছেন ইয়াবা। গবেষকরা এও বলছেন দিন দিন এই নিদির্ষ্ট মাদকটির সহজপ্রাপ্যতার কারণেই এর দিকে ঝুঁকে পড়ছে নারী-শিশুসহ আজকের যুবসমাজ। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৮ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ পুরুষ, ১৬ শতাংশ রয়েছে নারী। আর দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখেরও মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোরেরাও এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৭ লাখ। যার মধ্যে ৯০ শতাংশ কিশোর ও তরুণ। মাদকাসক্তদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। পথশিশুদের একটি বড় অংশ মাদকে আসক্ত। মাদকের হিংস্র থাবায় দেশের নারী শিশু ও যুবসমাজ এক পা দু’পা করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে মাদকাসক্তরা মাদক ক্রয়ের অথর্ সংগ্রহ করতে বিভিন্ন ধরনের চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে একের পর এক জড়িয়ে পড়ছে। সমাজের উচ্চবিত্ত ও অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েরা ফেনসিডিল ও ইয়াবা কেনার টাকা সংগ্রহে পারিবারিকভাবে বাবা-মায়ের ওপর চাপ প্রয়োগসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। পাশাপাশি নারী নিগ্রহ, ধষর্ণ ও খুনের মতো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এর ফলে বহু পরিবারের স্বপ্ন ধ্বংসের পথে। কারো কারো স্বপ্ন ইতিমধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, মাদকাসক্ত নারীদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। তারা সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতাসহ ও বিভিন্ন রোগ-শোকে আক্রান্ত হচ্ছে। মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা সেবনে পুরুষের চেয়ে নারী ও শিশুদের সমস্যা হয় বেশী। অনেক পরিবার লোকলজ্জার ভয়ে ভুক্তভোগী নারীদের বিষয়টি সম্মুখে আনতে চায় না। স্মরণ রাখতে হবে, সব ধরনের মাদককে ‘না’ বলতে হবে। পাশাপাশি মাদকাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পুনবার্সনসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে। শুধু তাই নয়, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সকলকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এগিয়ে আসতে হবে।