ঝিনাইদহের নারী উদ্যোক্তা রোমেনার সাফল্য

লক্ষ্ণীকোল গ্রামের সখিনা খাতুন (৩৫) জানান, ১০ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। দুই বছর সংসার করার পর স্বামী তাড়িয়ে দেয়। জীবনের অন্ধকার পথে খোঁজ পায় রোমেনা আপার। কাজ শুরু করি, এখন প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় হয়। এই আয়ে সংসার চালিয়ে ৪ শতক জমিও কিনেছেন। সেখানে টিনের ঘর বেঁধে মা-মেয়ে থাকেন।

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
রোমেনা বেগম। বয়স ৫০-এর কাছাকাছি। ১৫ বছর আগের কথা, মাত্র ২০ গজ কাপড় আর একটি সেলাই মেশিন নিয়ে শুরু করেছিলেন। সুই-আর সুতাই ঘুরিয়েছেন অসংখ্য অসহায় নারীর জীবন। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে কমপক্ষে ২০০ অসহায় নারীর সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। শুধু সুই-সুতার কাজ করেই এই নারী উদ্যোক্তা রোমেনা বেগমের আজ ঝিনাইদহ শহরে একটি বাড়ি হয়েছে। আছে একটি বিশাল বড় শো-রুম। ঢাকা, খুলনা ও বরিশালসহ নানা স্থানে তাদের হাতের কাজ করা পণ্য সরবরাহ হচ্ছে। রোমেনা বেগমের ভাষ্য, শুরুতে নিজের মতো করে কাজ করে যেতেন। কিন্তু সফলতা আনতে পারছিলেন না। ২০১৪ সালে ঝিনাইদহ জেলা সমবায় অফিসের কর্মকর্তারা তার পাশে দাঁড়ান। প্রথমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এরপর নানা পরামর্শ দেন। তারা রোমেনার তৈরি পণ্য বিভিন্ন মেলার স্টলে প্রদর্শন করেন। এভাবেই তার তৈরি পণ্যগুলো অল্পদিনে জনপ্রিয়তা পায়। রোমেনা বেগম ঝিনাইদহ শহরের গীতাঞ্জলি সড়কের বাসিন্দা ইয়াসিন আলী বিশ্বাসের স্ত্রী। ১৯৮৬ সালে তার বিয়ে হয়। এরপর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পর সংসারে মনোযোগ দেন। ফলে পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। তবে, নতুন করে পড়ালেখা শুরু করেছেন। তার মেয়ে রুবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে রিয়াজ আহম্মেদ পড়ালেখা করছে। স্বামীর ঝিনাইদহ শহরে ছোট একটি কসমেটিক্সের দোকান রয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের বাসুদেবপুরে। রোমেনা বেগম জানালেন, বিয়ের পর তাদের সংসার চলছিল না। ২০০৫ সালে স্বামী-স্ত্রী শহরে চলে আসেন। স্বামী ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু তেমন পুঁজি না থাকায় ব্যবসা ভালো চলছিল না। এই অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজে কিছু একটা করবেন। ছোটবেলা থেকেই হাতের কাজের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। তাই বেছে নেন হাতের কাজ। শুরু করেন নকশিকাঁথা, থ্রি-পিচ, কুশন, বেডসিট, বালিশের কভারসহ নানা পণ্য তৈরি। প্রথম যখন এই কাজ শুরু করেন তখন একটি সেলাই মেশিন কেনার পর কাছে পুঁজি ছিল মাত্র ২০ গজ কাপড় কেনার। এই দিয়ে শুরু করেন কাঁথা সেলাই কাজ। ২ বছর পর তার কাছে প্রতিবেশী অসহায় ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীরা আসতে শুরু করেন। অনেকে আছেন স্বামী আরেকটি বিয়ে করে নিয়েছেন। এ সব অসহায় নারীর কথা শুনে তিনি তার হাতের কাজে যুক্ত করেন। একসঙ্গে কাজ দেন ৮ থেকে ১০ জন নারীকে। কাজের পরিধি বেড়ে গেলে তিনি প্রতিষ্ঠানের একটি নাম দেন 'সেল্টার সমাজ কল্যাণ সংস্থা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাড়িতে বসে অসহায় নারীদের নিয়ে কাজ করেছেন। এরপর ঝিনাইদহ সমবায় অফিসের কর্মকর্তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি সমবায় থেকে রেজিস্ট্রেশন নেন। বর্তমানে তার এই সংগঠনের সদস্য ৩৮ জন। রোমেনা সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তার এই সংগঠনের মাধ্যমে বর্তমানে কালীগঞ্জে ২০ জন, যশোরে ৫০ জন, খাজুরায় ৩০ জন ও ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক নারী কাজ করছেন। রোমেনা বেগম জানান, জেলা সমবায় অফিসের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ জন নারী সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সমবায় অফিসের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে সমবায় অফিস তাদের তৈরি পণ্য একাধিক মেলায় প্রদর্শন করে। যার কারণে পণ্য বিক্রির পাশাপাশি মানুষের মধ্যে চাহিদা বেড়েছে। মেলা থেকে দেখার পর অনেকেই তার কাছে এগুলো কেনার জন্য আসছেন। বর্তমানে তিনি মাসে ৩ লক্ষাধিক টাকার পণ্য বিক্রি করছেন। এ থেকে তার আয় হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। যা স্বামীর আয়ের পাশাপাশি সংসারে সচ্ছলতা ফেরাচ্ছে। তা ছাড়া তার এখানে কাজ করে অন্য নারীদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। তাদের সমিতির বর্তমান মূলধন ২০ লাখ টাকা। আর সঞ্চয় আমানতের পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার টাকা। সমিতির সদস্য লক্ষ্ণীকোল গ্রামের সখিনা খাতুন (৩৫) জানান, ১০ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। দুই বছর সংসার করার পর স্বামী তাড়িয়ে দেয়। জীবনের অন্ধকার পথে খোঁজ পায় রোমেনা আপার। কাজ শুরু করি, এখন প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় হয়। এই আয়ে সংসার চালিয়ে ৪ শতক জমিও কিনেছেন। সেখানে টিনের ঘর বেঁধে মা-মেয়ে থাকেন। দশম শ্রেণির ছাত্রী সাথী কর্মকার জানায়, হতদরিদ্র বাবা বিশু কর্মকার তার পড়ালেখার খরচ দিতে পারে না। এখন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে পড়ার খরচ জোগাড় করেন। ঝিনাইদহ জেলা সমবায় কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল কুদ্দুস জানান, শুধু রোমেনা নয় তারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় অনেককে এভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। সমবায় একটা শক্তি। এটা প্রমাণে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।