তবে নিরাপদ কোথায়?

নারী নির্যাতনের অনেক ধরনের মূল্য দিতে হয়। তা সমাজকে আঘাত করে। নির্যাতনের হার দেখে একটি সমাজের অবস্থান বলে দেওয়া যায়

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুলস্নাহ
'কোথায় মেরেছে? কীভাবে মেরেছে? কতটুকু লেগেছে? এ নিয়ে ভাবার সময় নেই। শুধু চিন্তা- কেউ দেখার আগে কখন সে থামবে? তাহলে সম্মান বাঁচবে দুজনার। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলাম। ঘুষির পর ঘুষি, লাথির পর লাথি আসতেই থাকল। পরিশেষে কি হলো, বোঝার মতো জ্ঞান ছিল না।' কথাগুলো এক অসহায় ও নির্যাতিত নারীর বুকফাটা আর্তনাদ। স্বামীর অকথ্যভাবে শারীরিক নির্যাতনে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সংজ্ঞা ফেরার পর এভাবেই তার মনের আকুতি একটুকরো সাদা কাগজে প্রকাশ করে। সমাজে অসংখ্য নারী আজ হয় মানসিক না হয় শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার। মানুষ নামের কিছু পুরুষ আজ মানুষের চরিত্র নির্বাসন দিয়ে পশুর চরিত্র ধারণ করেছে। তারা আজ এভাবেই নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। প্রতিনিয়ত দেশে যে পরিমাণ নারী নির্যাতন হয়, বিভিন্নভাবে তার পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হলে কলেবর শেষ হবে না। জাহেলি যুগে নারীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছিল, বর্তমানে কখনো কখনো তার সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন- 'নারী নির্যাতনের অনেক ধরনের মূল্য দিতে হয়। তা সমাজকে আঘাত করে। নির্যাতনের হার দেখে একটি সমাজের অবস্থান বলে দেওয়া যায়। নারী নির্যাতনের ফলাফলগুলো হলো- মানুষের দুঃখ, ব্যথা, চাকরিচু্যত হওয়া, হত্যাসহ নানান কিছু। কর্মক্ষেত্রে অথবা প্রকাশ্য জনসমাগমের স্থানে যৌন নির্যাতনের শিকার হলে কাজ থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। নির্যাতন সবধরনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। এ ধরনের ক্ষতিগুলো সামাজিক ক্ষতি।' তারা আরও বলছেন- 'পরিবারের যে ছেলেশিশুরা নির্যাতন দেখে দেখে বড় হয়, তারা ভবিষ্যতে নির্যাতকের ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলতে থাকে। নির্যাতনের পর স্বাস্থ্য খরচ, কাজ-কামাই করাসহ বিভিন্ন খাতে বিশ্বে নূ্যনতম দেড় লাখ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে। এই দেড় লাখ কোটি ডলারের ২ শতাংশও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে সমতা অর্জন করা সম্ভব।' বর্তমান সমাজের একটি বিশাল ব্যাধি 'নারী নির্যাতন'। সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন এ প্রবণতা বেড়ে চলেছে। মানুষ যতই সচেতন হচ্ছে, ততই নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞতা বৃদ্ধি পাচ্ছে; বৃদ্ধি পাচ্ছে উদাসীনতা। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষাসহ নানা কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। দুঃখজনক হলেও সত্য, পৃথিবীব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃতু্য হচ্ছে। কারণ তারা মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে। দেখা যায়- সমাজের সচেতন ও প্রভাবশালী মানুষের মাধ্যমেই নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটছে। নির্যাতনকারীরা প্রভাব ও প্রতিপত্তির কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। নারী নিজ পরিবারেও নির্যাতিত হচ্ছে। পরিবার পেরিয়ে বাইরেও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে তাকে। অনেক নারী চাইলেও নিজ পরিবারের কাছে সহিংসতার কথা খুলে বলতে পারছে না। দেখা যায়, অনেক সময় পরিবারই নির্যাতিত নারীকে দোষী সাব্যস্ত করে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারে না। পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে অনেক নারীই এসব অত্যাচার সহ্য করে বাধ্য হয়ে। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে উঠে আসছে নারী নির্যাতনের কোনো না কোনো ঘটনা। গবেষণা বলছে, গত দুই দশকে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিশ্ব উদাহরণ মানলেও এর মধ্যেই ধুঁকছেন কোটি কোটি নারী। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণা বলছে, পুরুষতন্ত্রে প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, নারী ঘরেই নিরাপদ। অথচ এই সহিংসতার বেশির ভাগ হয় বাড়িতেই। ঘরের প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন নারীই নানাভাবে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হন। বিবাহিত নারীদের ৮২ শতাংশই স্বামীর হাতে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস)। বিবিএস বলছে, যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। আর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিবাহিত নারীরাই নিপীড়নের শিকার হন বেশি।